ছোটগল্প কি বা কাকে বলে?
ছোটগল্প (short story) হচ্ছে কয়েকটি চরিত্র নিয়ে কাল্পনিক তৈরি একটি গদ্য। সাধারনত, একটি ছোট গল্প একটি উপন্যাসের চেয়ে অনেক ছোট হয়ে থাকে। অর্থাৎ, যদি একটি উপন্যাস একটি সমুদ্র হয়, তাহলে একটি ছোট গল্প হবে পুকুরের সমান। ছোট গল্পে কয়েকটি পর্বের মাধ্যমে সম্পূর্ণ গল্প তুলে ধরা হয়। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পৃথিবীর নানা ভাষায় রোমান্স, ধর্ম, নীতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক গল্প। বাংলা সাহিত্যে বাংলা ভাষায়ও আছে অনেক প্রচলিত এবং কাল্পনিক গল্প। এইদিক থেকে ছোটগল্প সাহিত্য কিন্তু অন্য এক শিল্পকর্ম। ছোটগল্পের সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন আমেরিকান গল্প লেখক এডগার এলেন পো। পোর মতে, " যে গল্প অর্ধ থেকে এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায় তাকেই ছোটগল্প বলে। "
ছোটগল্পের ইতিহাস ও উৎপত্তি
ছোটগল্প বাঙালীর কাছে যেমন পুরাতন, তেমনিভাবে অনেক নতুন। অনুমান করা হয় যে, ছোটগল্পের পথ শুরু হয় ১৩৩০ শতাব্দীর দিকে Gesta Romanorum বই দিয়ে, যা একটি ইতালীয় সাহিত্য। ইংরেজী সাহিত্যে Aesops Fables, Chaucer-এর গল্প দিয়ে ছোটগল্পের যাত্রা শুরু হয়। এছাড়াও, সংস্কৃতে বিষ্ণুশর্মার 'হিতোপদেশ', সোমদেবের 'কথাসরিৎসাগর', বোদ্ধ সাহিত্যে 'জাতকের গল্প' নামক ছোটগল্পগুলি কালজয়ী হয়ে থাকবে। আধুনিকযুগের ছোটগল্পে কথোপকথন লক্ষ করা যায়, যা প্রাচীনকালের ছোটগল্পে দেখা যেত না।
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের আবির্ভাব
'বঙ্গদর্শন' পত্রিকার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের যাত্রা শুরু হয়। তবে 'টেল' (tale) বা উপাখ্যান বিষয়ক গল্প বাংলা সাহিত্যে প্রথম আবির্ভাব হয়েছে। ভূদেব মুখোপাধ্যায় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝিতে ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। সুরেশচন্দ্র সমাজপতির 'সাহিত্য', বঙ্কিমের 'বঙ্গদর্শন', 'রাধারাণী', 'সাধনা' শিল্পকর্মে অনেক ছোটগল্পের আবির্ভাব ঘটেছে। কিন্তু, প্রাচীন যুগে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সর্বশ্রেষ্ট ছিলেন ছোটগল্প সাহিত্যেকর্মে। তার গল্পে বৈচিত্র এবং বহুলতা ছিল। ছোটগল্পে হাসির গল্প তেমন একটা নেই বাংলা সাহিত্যে। রাজশেখর বসু (পরশুরাম) হাসির গল্প লিখে বাংলা সাহিত্যকে মনোরঞ্জন করেছেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ছোটগল্পে অনেক অবদান রেখে গিয়েছেন। তবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক গল্পকার। ছোটগল্পে তার অবদান অপরিসীম। বাংলা ছোটগল্পে পূর্ণতা, সজীবতা, এবং বিকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে। তার গল্পে সামাজিক জীবন-যাপন, ধর্মের গোড়া, গভীর প্রেম, এবং বাংলার মানুষের জীবন বৈচিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে ক্ষুদ্র, কিন্তু কনিষ্ট সন্তান হচ্ছে ছোটগল্প।
ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য
১. ছোটগল্পের সাইজ বা দৈর্ঘ্য বা শব্দ সংখ্যা: এডগার অ্যালান পোয়ের মতে ছোটগল্প হবে ৭,৫০০ শব্দ থেকে ২০,০০০ শব্দের মধ্যে। এই তথ্যটি পো তার 'The Philosophy of Composition' (দ্য ফিলোসফি অফ কম্পোজিশন) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেলিন।
২. ছোটগল্পের চরিত্র সংখ্যা: ছোটগল্পের চরিত্র সংখ্যা হবে সর্বনিম্ন দুই এবং সর্বোচ্চ পনের।
৩. ছোটগল্পের পর্বের সংখ্যা হবে দুই অথবা তিন।
৪. একটি ছোটগল্প শুধুমাত্র একটি ঘটনা থাকবে এবং সেই ঘটনা দিয়ে গল্পটি সমাপ্ত হবে।
৫. একটি ছোটগল্প একটি নির্দিষ্ট সময় চলতে থাকবে। এডগার অ্যালান পোয়ের মতে এক ঘন্টা বা দুই ঘন্টা ব্যাপ্তি হবে।
৬. একটি ছোটগল্প একটি নির্দিষ্ট নাটকীয় গঠন অনুসরণ করবে। (যেমন: গল্পের শুরুর পরিস্থিতি, ভূমিকা, প্রধান চরিত্র, এবং আরও অনেক)
সোর্স: উইকিপিডিয়া, দ্য ফিলোসফি অফ কম্পোজিশন
আরো পড়ুনঃ কবিতা কি, বৈশিষ্ট্য, শ্রেণীবিভাগ ও কাব্যগ্রন্থ
ছোটগল্পের গঠন অথবা স্ট্রাকচার (structure)
১. শুরুতেই বর্ণনামূলক লিড প্রকাশ করতে হবে: প্রথম পর্বে গল্পের প্রধান চরিত্রকে তুলে ধরতে হবে।
২. প্রধান চরিত্রের পরিচয় দিতে হবে।
৩. পরিবেশ তুলে ধরুন। প্রধান চরিত্রের জীবন, পরিবেশের সময়, স্থান, এবং প্রধান চরিত্রের সাথে অন্যান্য চরিত্রের সম্পর্ক।
৪. প্রধান চরিত্র কোন বিষয় নিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
৫. ধীরে ধীরে একটি ক্লাইম্যাক্সের দিকে গল্পকে নিয়ে যান।
৬. প্রধান চরিত্রের অ্যাকশন (চারিত্রিক) পরিবর্তন করুন।
৭. ক্লাইম্যাক্স বর্ণনা করুন এবং প্রধান চরিত্রের সমস্যার কথা উল্ল্যেখ করুন।
ছোটগল্পের বিভিন্ন ধরন বা শ্রেণীবিভাগ
ছোটগল্পের বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে এই পর্যন্ত যেই টাইপের বা ধরনের ছোটগল্প লেখকরা লিখেছেন, তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হল।
১. অ্যাডভেঞ্চার, ২. জীবনী, ৩. কমেডি, ৪. অপরাধ, ৫. গোয়েন্দা, ৬. নাটক, ৭. ডাইস্টোপিয়া (কোন এক ধ্বংসের স্থান), ৮. উপকথা (ফ্যাবল) , ৯. ফ্যান্টাসি (কল্পনা জগৎ নিয়ে), ১০. ইতিহাস, ১১. হরর (ভয়), ১২. রহস্য, ১৩. দর্শন, ১৪. রাজনীতি, ১৫. রোম্যান্স, ১৬. ব্যঙ্গ, ১৭. বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, ১৮. অতিপ্রাকৃত বা সুপার ন্যাচারাল, ১৯. থ্রিলার, ২০. ট্র্যাজেডি, ২১. অ্যাকশন, এবং ২২. পশ্চিমা (পশ্চিমা দেশের পরিবেশ নিয়ে)। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোটগল্পের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে আলোচনা করা হলো। নিম্নোক্ত শ্রেণীবিভাগগুলো শ্রীশচন্দ্র দাশের 'সাহিত্য সন্দর্শন' বই থেকে নেয়া হয়েছে।
সামাজিক: সামাজিক জীবন-যাপন, পরিবেশ, এবং সামাজিক রসই এই শ্রেণীবিভাগের প্রধান বিষয়। উদাহরণস্বরুপ, রবীন্দ্রনাথের 'হালদার গোষ্ঠী' এবং শৈলজানন্দের 'কয়লাকুঠি'
ঐতিহাসিক: এই ধরণের ছোটগল্প ইতিহাসের গুরুত্যপূর্ণ ঘটনা নিয়ে আলোকপাত হয়। উদাহরণস্বরুপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'দালিয়া'
প্রেমবিষয়ক: প্রেমের লীলা, সমাজের চোখে প্রেমের অবস্থা, বিচিত্র পরিবেশের প্রেম, প্রেমের শেষ পরিণতি ইত্যাদি এই শ্রেণীবিভাগের মধ্যে পড়ে। উদাহরণস্বরুপ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'ভস্মশেষ'
হাস্যরস: এই শ্রেণীর গল্পগুলো হাস্যরস এবং মধুরতাময় হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরুপ, রাজশেখর বসুর 'ভূষন্ডির মাঠে' এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অধ্যাপক'
মানুষ ও প্রকৃতি: প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক, প্রকৃতিতে মানুষের সুখদুঃখের গল্প 'মানুষ ও প্রকৃতি' ছোটগল্পে তুলে ধরা হয়। উদাহরণস্বরুপ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অতিথি'
অতিপ্রাকৃতি (সুপার ন্যাচারাল): অলৌকিক রহস্য নিয়ে গল্পগুলি এই শ্রেণীর অন্তরর্ভুক্ত। অতিপ্রাকৃতি গল্পের শেষ পরিণতি খুবই ভয়াবহ হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরুপ, কাজী নজরুল ইসলামের 'পদ্ম গোখরো', রবীন্দ্রনাথের 'নিশীথে'
উদ্ভট: এ শ্রেণীর গল্পে অবাস্তব এবং অসম্বভ ঘটনা নিয়ে লিখা হয়। উদাহরণস্বরুপ, বিভুতিভূষণ মুখোপাধ্যায় এর 'নারায়ণী মেলা'
গোয়েন্দা: অপরাধ জনিত ঘটনার রহস্য উধঘাটন, হত্যার কারণ বের করা ইত্যাদি এই শ্রেণীর অন্তরর্ভুক্ত।
সাঙ্কেতিক: বিশেষ ঘটনাকে অন্য ভাবে প্রকাশ করা হয় এই ছোটগল্পে। উদাহরণস্বরুপ, রবীন্দ্রনাথের 'তাসের দেস'
মনোস্তাত্বিক (সাইকোলজাল): মানুষের মনের ভাব নিয়ে জমে উঠে এই শ্রেণীর গল্পের রস। উদাহরণস্বরুপ, শরৎচন্দ্রের 'রামের সুমতি', রবীন্দ্রনাথের 'পোস্ট মাস্টার'
বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য ছোট গল্পের তালিকা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি অথবা হৈমন্তী গল্প কে না পড়েছে। ছুটি অথবা হৈমন্তী গল্প পড়ার মাধ্যমে আমরা ছোট গল্পের সাথে পরিচিত হয়েছি। আরো অসংখ ছোট গল্প রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। কবিদের নামসহ তালিকাটি নিম্নোক্ত।
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ছুটি, হৈমন্তী, সমাপ্তি, নষ্টনীড়, একরাত্রি, ল্যাবরেটরি, ক্ষুধিত পাষান, কঙ্কাল, জীবিত ও মৃত, মণিহার, গুপ্তধন, এবং পোস্টমাস্টার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প নিয়ে প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
ক . রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম ছোটগল্প হচ্ছে 'ভিখারিণী'
খ . 'গল্পগুচ্ছ' বইটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের সংকলন।
গ . 'ফটিক' চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' ছোটগল্পের।
ঘ . 'দেনাপাওনা' হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ছোটগল্পের নাম এবং একই নাম শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস রয়েছে।
ঙ . 'শিশুরাজ্যে এই মেয়েটি একটি ছোটখাটো বর্গির উপদ্রব বলিলেই হয়', এই বিখ্যাত উক্তিটি 'সমাপ্তি' ছোটগল্পের।
২. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: মন্দির, মেজদিদি, বিন্দুর ছেলে, রামের সুমতি, বিলাসী, মহেশ, মামলার ফল, এবং পরেশ।
৩. প্রমথ চৌধুরী: চার ইয়ারী কথা, আহুতি, নীললোহিত, ফার্স্টক্লাশ ভূত, ফরমায়েশী গল্প, ট্রাজেডির সূত্রপাত, এবং গল্পসংগ্রহ।
৪. তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়: জলসাগর, বেদেনী, পাষাণপুরী, নীলকন্ঠ, ছলনাময়ী, এবং ডাক হরকরা।
৫. বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়: মেঘমাল্লার, মৌরিফুল, যাত্রাবদল, জন্ম ও মৃত্যু, কিন্নর দল, এবং বিধু মাস্টার।
৬. মানিক বন্দোপাধ্যায় (প্রবোধচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়): অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প, প্রগৈতিহাসিক, সরীসৃপ, এবং আজকাল পরশু'র গল্প।
৭. আবু ইসহাক: জোঁক।
৮. সৈয়দ মুজতবা আলী: ধূপছায়া, টুনিমেম, পাদটীকা, এবং রসগোল্লা।
৯. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: নয়নচারা, দুই তীর ও অন্যান্য গল্প, না কান্দে বুবু, এবং গল্পসমগ্র।
১০. আকবর উদ্দিন: অসমাপ্ত কাহিনী ও অন্যান্য গল্প।
১১. আকবর আলী খান: গলির ধারের ছেলেটি, কাগজের নৌকা, এবং শেষ নালিশ।
১২. শওকত আলী: উম্মুল বাসনা, লেলিহান সাধ, এবং শুন হে লখিন্দর।
১৩. আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: প্রেমের গপ্পো, রেইনকোট, ফোঁড়া, ফেরারী, পায়ের নিচে জল, নিরুদ্দেশ যাত্রা, কান্না, যুগলবন্দি, অপঘাত, সন্তু, ঈদ, এবং মিলির হাতে স্টেনগান।
১৪. হুমায়ুন আহমেদ: আনন্দ বেদনার কাব্য, নিশিকাব্য, শীত ও অন্যান্য গল্প, এলেবেলে, ছায়াসঙ্গী, জলকন্যা, এবং নলিহাতি।
১৫. আল মাহমুদ: পানকৌড়ির রক্ত, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধবণিক, এবং ময়ূরীর মুখ।
১৬. কাজী নজরুল ইসলাম: ব্যাথার দান, শিউলিমালা, রিক্তের বেদন।
১৭. আবুল মনসুর আহমদ: আয়না, ফুড কনফারেন্স, আসমানী পর্দা।
১৮. মাওলানা আকরাম খাঁ: মন পবন, যৌবন জ্বালা, কামিনী কাঞ্চন, প্রকৃতির পরিহাস।
১৯. আবু জাফর শামসুদ্দীন: জীবন, একজোড়া প্যান্ট ও অন্যান্য গল্প, রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা, শেষ রাত্রির তারা।
২০. ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ: ধানকন্যা, মৃগনাভি, জেগে আছি।
0 মন্তব্যসমূহ