দর্শনের একটি 'গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো নীতিবিদ্যা। নীতিবিদ্যার একটা
সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আছে এবং এ বিষয়বস্তু
সম্পর্কে নিশ্চিত; যথার্থ, সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জ্ঞান দান করাই নীতিবিদ্যার লক্ষ্য।
নীতিবিদ্যা পাঠের সদর্থক ও নঞর্থক এবং
তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় প্রকার প্রয়োজন বা মূল্য বর্তমান। তাই নীতিবিদ্যা পাঠের
প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা
প্রতিটি জ্ঞানের শাখায় নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
এ প্রয়োজনীয়তা নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নিম্নে
নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো।
১. নৈতিকতা সম্পৰ্কীয় আলোচনার গুরুত্ব
সক্রেটিস তাঁর বিচারকদের সামনে অপরীক্ষিত জীবনযাপনের যোগ্য নয় বলে
যে যুক্তিটি উপস্থাপন করেন তা যদি সত্য হয়, তাহলে তা ৩৯৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে
যেমন সত্য বলে পরিগণিত (Calculated) হতো, তেমনি তা সব যুগে সব সমাজেই বিবেক সচেতন মানবকুলের কাছে সত্য বলে পরিগণিত হতো।
নীতিবিদ্যার একটা প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নৈতিকতা সম্পৰ্কীয় এ ধরনের প্রশ্নের একটা যুক্তিসম্মত উত্তর নিরূপণ করা। নৈতিকতা
সম্পর্কীয় আলোচনাতে নীতিবিদগণ যেমন যুক্তি উপস্থাপন করেন, সেগুলোর গুরুত্ব মানবজীবনের পরীক্ষার ক্ষেত্রে কোন অংশে কম
নয়।
২. সৎ জীবনযাপন উপযোগী অন্তর্দৃষ্টি
নীতিবিদ্যা পাঠ করার ফলে সৎ জীবনযাপন করার জন্য যে অন্তর্দৃষ্টি
প্রয়োজন, তা লাভ করা যায়। নীতিবিজ্ঞান পাঠ না করে
আমরা যে জীবনযাপন করি, নীতিাির পাঠ করে তা অপেক্ষা উন্নততর, অধিক সম্ভ্রান্ত এবং
ত্রুটিহীন জীবনযাপন লাভ করতে পারি।
৩. নীতিবিদ্যার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান
অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জির (Mackenzie) মতে, “নীতিবিদ্যা কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানের জন্য
ন্যায়ত্ব বা অন্যায়ত্বের প্রেক্ষিতে মানব আচরণের আলোচনা করে।" তাত্ত্বিক
বিজ্ঞানের কাজ হলো তত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান দান করা। নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে ম্যাকেঞ্জি বলেন, “নীতিবিদ্যা হচ্ছে মানবজীবনের
সঙ্গে জড়িত আদর্শ সম্পর্কীয় সাধারণ বিদ্যা বা বিজ্ঞান"।
৪. ব্যক্তি তথা সমাজ গঠনে নীতিবিদ্যা
সমাজ তথা দেশের সামগ্রিক উন্নতি বা প্রগতির স্বার্থে নৈতিক মূল্যবোধের
অবক্ষয়কে পুরোপুরি রোধ করতে হলে নৈতিকতা শিক্ষার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা
আছে। নৈতিকতা অভ্যাস ও চর্চার ব্যাপার হলেও এর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য নৈতিকতার তাত্ত্বিক জ্ঞানের যেমন প্রয়োজন আছে,
তেমনি এ তাত্ত্বিক জ্ঞান তখনই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে, যখন তা বাস্তবে রূপায়িত হয়।
৫. সমৃদ্ধ সমাজে জীবনযাপনে সাহায্য করে
নীতিবিদ্যা পাঠের ফলে আমাদের নীতিবোধ সুষ্ঠু ও সতেজ হয়। ফলে আমরা সমৃদ্ধিসম্পন্ন সমাজে জীবনযাপন করতে পারি।
৬. সুস্থ জীবনযাপনে নীতিবিদ্যা
নীতিবিদ্যা পাঠের একটি প্রয়োজনীয় শর্ত হলো নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি
বা নৈতিক দক্ষতা। নৈতিক পরীক্ষা, নৈতিক সিদ্ধান্ত ও নৈতিক
বিষয়াবলির আলোচনার ক্ষেত্রে একটা অপরিহার্য শর্ত। নীতিবিদ্যা পাঠের ক্ষেত্রে বিষয়গত,
বুদ্ধিসম্মত, সামর্থ্য, নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি, নৈতিক
পরীক্ষা ও নৈতিক সিদ্ধান্ত অপরিহার্য শর্ত হিসেবে কাজ করে থাকে বলে নীতিবিদ্যা
পাঠের মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির
প্রভাব পড়ে এবং এর ফলে নীতিবিদ্যার পঠনপাঠন ব্যক্তির সুস্থ সমাজজীবন
গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে ।
৭. নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়রোধে নীতিবিদ্যা
নীতিবিদ্যা নৈতিকতা বা নৈতিক মূল্যবোধ কী, নৈতিকতা, নৈতিকতা নিরপেক্ষ ও অনৈতিকতার পার্থক্য কিভাবে নিরূপণ করা যায়, নৈতিক মূল্যবোধ কিভাবে
অন্যান্য মূল্যবোধ থেকে পৃথক, ন্যায়-অন্যায়
বা ভালোমন্দের পার্থক্য কিভাবে সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়,
প্রথা ও লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য কি, নৈতিক গুণাবলি ও সাধারণ গুণাবলির মধ্যে পার্থক্য কী, নৈতিক গুণাবলি কিভাবে অর্জন
করা যায়, নৈতিকতা কী কী উপাদানের উপর নির্ভর করে, এসব বিষয়ের বিশদ আলোচনা করে।
৮. দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার এবং উদ্দেশ্যকে দৃঢ় করে
নীতিবিদ্যা পাঠের ফলে নৈতিক ব্যাপার সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
উদার এবং আমাদের উদ্দেশ্য দৃঢ় হয়। ভালো লোকের ক্ষেত্রে এ গুণগুলোর
অত্যুৎকৃষ্ট ও স্থায়ী মূল্য রয়েছে এবং নীতিবিদ্যার ছাত্রছাত্রী অন্য
সাধারণ লোকের চেয়ে এ গুণগুলো অর্জন করার জন্য যথেষ্ট
সুযোগ পেয়ে থাকে, তা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, নীতিবিদ্যার পঠনপাঠনের মূল্য অন্যান্য বিদ্যার
মতো তাৎক্ষণিক বা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের ব্যবহারিক
জীবনে কোন প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও এর পরোক্ষ মূল্য নেই তা বলা যায় না। প্রতিটি
মানুষেরই দৈনন্দিন জীবনে সুস্থ জীবনযাপনের
জন্য নীতিবিদ্যা পাঠের প্রয়োজন আছে। নীতিবিজ্ঞানের অনুশীলনই আমাদের নীতিবোধকে সুষ্ঠু
ও সতেজ করে আমাদের সমাজজীবনকে সমৃদ্ধশালী
করে তুলতে সহায়তা করে। সুতরাং সুস্থ সমাজ জীবনযাপনের স্বার্থে মানুষের মানবোচিত জীবনযাপনের
ক্ষেত্রে নীতিবিদ্যার প্রয়োজনীয়তা
ও মূল্যকে অস্বীকার করা যায় না।
0 মন্তব্যসমূহ