মদিনা সনদের ১১টি প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

 

মদিনা সনদের ১১টি  প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মদিনা সনদের ১১টি  প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যামূলক আলোচনা

মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে মদিনা সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিম্নে আলোচনা করা হলো।

১. প্রথম লিখিত সংবিধান

৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রণীত ও বাস্তবায়িত মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। মদিনা সনদের পূর্বে রচিত ও কার্যকরীকৃত আইন ছিল স্বৈরাচারী শাসকের আদেশ এবং সরকার ছিল ব্যক্তিগত কেন্দ্রীভূত শাসক। মদিনা সনদের অনেক পরে ইংল্যান্ডে 'ম্যাগনাকার্টা' রচিত হয়। 'ম্যাগনাকার্টার’ এর সাথে তুলনা করে মদিনা সনদকে 'ম্যাগনাকার্টা' বলা হয়।

২. হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

ইসলাম ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের নেতৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক ও মুসলিম বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একই নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে আসার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়।

৩. উদারনীতি

হযরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্মীয় মতাদর্শের ব্যাপারে অত্যন্ত উদার ছিলেন। তিনি মদিনায় বসবাসরত সকল ধর্মের ব্যক্তিদের সাথে মিলেমিশে থাকতে চেয়েছেন। তিনি কোনো সম্প্রদায়ের উপর ইসলাম ধর্মকে চাপিয়ে দেননি। এ কারণে সনদে ঘোষণা করা হয়- প্রত্যেক গোত্র, ব্যক্তি নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ভোগ করবে।

৪. ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ

মদিনা সনদ গোত্রপ্রথার বিলোপসাধন করে। স্বৈরাচারী শাসন শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্রে স্বীকৃতি লাভ করে। ঐশীতন্ত্রের আবির্ভাবও হয় এ কারণে।

৫. ভ্রাতৃসংঘ ও ঐক্য

মদিনা সনদ মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়কে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে হিংসা, দ্বেষ ও কলহের অবসান ঘটায়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র সংরক্ষণে স্ব-স্ব গোত্রের যুদ্ধ ব্যয় বহনের ব্যবস্থা হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দূরদর্শিতা ও অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতার পরিচায়ক।

৬. হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ক্ষমতা বৃদ্ধি

মদিনা সনদের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এ সনদের দ্বারা নবীজির উপর মদিনার শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব অর্পিত হয়।

৭. নাগরিক অধিকার অর্জন

মদিনা সনদে নাগরিকদের যে সমান অধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয় তা ছিল আধুনিক গণতন্ত্রের পথিকৃৎ এবং বিশ্বের সম্পূর্ণ নতুন শাসন পদ্ধতি। তাই বলা যায়, এ সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।

৮. গোত্রীয় সম্প্রীতি

মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী (সা.) কেবলমাত্র মদিনায় আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক কলহই নিরসন করেননি, অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেও মিলন ও ঐক্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

৯. রাজনৈতিক ঐক্য

মদিনা সনদের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সা.) মদিনার সকল গোত্রের লোকদেরকে একটি রাজনৈতিক ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ করেন। সনদের মাধ্যমে গোত্রীয় শাসনের অবসান ঘটে এবং বৃহত্তম স্বার্থে সনদে স্বাক্ষরকারীরা একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা উম্মা গঠন করেন। ফলে ক্ষুদ্র গোত্রীয় পরিচালকের পরিবর্তে বৃত্তের রাজনৈতিক প্রজাতন্ত্রের পরিচয় বহন করে।

১০. বৈপ্লবিক সংস্কার

ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা ছিল সতর্কতামূলক বৈপ্লবিক সংস্কার। এতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।

১১. পুনর্গঠনের পরিকল্পনা

মদিনা সনদে সংঘর্ষ বিক্ষুব্ধ মদিনার পুনর্গঠনে নবী করিম (সা.) এর পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত আরব জাহানকে একতাবদ্ধ করার একটি মহৎ পরিকল্পনা এ সনদে ছিল।

পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্বের ইতিহাসে মদিনা সনদের গুরুত্ব যে অপরিসীম ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি মহানবী (সা.) এর এক অনন্য সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার জন্য এ সনদে যে নীতিমালা গৃহীত হয়েছে তা সকল যুগে এবং সকল কালেই অনুসরণযোগ্য। আর এ নীতিমালা অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সর্বপ্রকারের কল্যাণ। এ সনদ নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকূটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহনশীলতা, জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন ও সমাজসংস্কারের মানবিক গুণাবলি প্রকাশ পায়। সুতরাং বলা যায়, মদিনা সনদ প্রণয়ন মহানবী (সাঃ) এর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ