জাতি কি
জাতি হচ্ছে জাতীয়তাবোধে
উদ্দীপ্ত এবং রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত এমন এক জনসমষ্টি যারা হয় স্বাধীন
অথবা স্বাধীনতাকামী। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে জাতি বলতে এক বংশোদ্ভূত জনসমষ্টিকে
বোঝায়। আধুনিককালে জাতি (race) বলতে এমন এক
জনসমষ্টিকে বোঝায়, যারা কতগুলো সাধারণ
ঐক্যবোধে আবদ্ধ ও সংগঠিত। অর্থাৎ, আমরা জাতি বলতে সেই জনসমষ্টিকে বুঝি, যারা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায়
বাস করে এবং যাদের মধ্যে বংশগত, ভাষাগত, বর্ণগত, কৃষ্টি
ও ঐতিহ্যগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য
বিরাজমান থাকে।
জাতীয়তা কি
জাতীয়তা হলো
একটি মানসিক ধারণা, যা কোনো একটি জনসমাজকে অন্য জনসমাজ থেকে পৃথক করে এবং নিজেদের
মধ্যে ঐক্যবোধ তৈরি করে। জাতীয়তা
হচ্ছে এক ধরনের মানসিক অনুভূতি। জাতীয়তা (nationality) নামক এই মানসিক অনুভূতির কারণেই ব্যক্তি নিজেকে অন্য জনসমাজ থেকে পৃথক ভাবে। এই জাতীয়তার কারণেই ব্যক্তি ভাষা
ও সাহিত্য, চিন্তা, প্রথা ও ঐতিহ্যের
বন্ধনে আবদ্ধ এক জনসমষ্টি। জাতীয়তা
নিজেদের মধ্যে ঐক্যবোধ তৈরি করে।
কীভাবে জাতির উদ্ভব হয়
মূলত জাতীয়তা
থেকেই জাতির উদ্ভব হয়। জাতি হচ্ছে এমন এক জনসমষ্টি যারা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক
এলাকায় বাস করে এবং যাদের মধ্যে ভাষাগত,
কৃষ্টি ও ঐতিহ্যগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক
ঐক্য বিরাজমান। জাতীয়তা একটি মানসিক ধারণা এবং এর মূর্ত রূপ হলো জাতি। কোনো জনসমষ্টি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ
হয়ে রাজনৈতিক সংগঠনে সংগঠিত হলে জাতিতে
পরিণত হয়। জাতি হয় স্বাধীন, না হয়
স্বাধীনতাকামী। এভাবেই জাতির উদ্ভব হয়।
জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য কী
জাতি ও জাতীয়তা এক বিষয়
নয়। উভয়ের মধ্যেই বহুবিধ পার্থক্য বিদ্যমান । যথা,
প্রথমত: জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন হয় জাতীয়তাবোধ
ও স্বাধীনতা। অপরদিকে, জাতীয়তা গঠনের জন্য
কতগুলো সাধারণ বিষয়বস্তুর মিল থাকতে হয়।
যেমন— ধর্ম, বংশ, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত: জাতি একটি বাস্তব
ও সক্রিয় রাজনৈতিক চেতনা। অন্যদিকে জাতীয়তা একটি মানসিক ধারণা ও আধ্যাত্মিক চেতনা।
তৃতীয়ত: জাতি অধিকমাত্রায় সুসংহত এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম। কিন্তু জাতীয়তা খুব বেশি সুসংহত নয়।
চতুর্থত: জাতি গঠনের জন্য রাজনৈতিক সংগঠন অপরিহার্য। অপরদিকে জাতীয়তা গঠনে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজন হয় না।
পঞ্চমত: জাতি হচ্ছে জাতীয়তার পরিণতি বা চূড়ান্ত পর্যায়। অন্যদিকে জাতীয়তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতি গঠনের প্রাথমিক অবস্থা বা পর্যায়। এ থেকেই বোঝা যায় যে, জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র
বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এ আন্দোলনের ফলে নিজস্ব জাতিসত্তা সৃষ্টিতে ভাষা ও সংস্কৃতির সম্পর্ক ও গুরুত্ব পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভাষাকেন্দ্রিক এই ঐক্যই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করে, যা পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে আন্দোলন পরিচালিত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা, সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ১১ দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়, ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণা এবং সর্বশেষ সুদীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন, এসব কিছুর পেছনে মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত বাংলার জনগণ প্রতিটি আন্দোলনকে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সফল করেছে। গঠন করেছে একটি নতুন জাতিরাষ্ট্র 'বাংলাদেশ'। উপরের আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন করেছিল।
0 মন্তব্যসমূহ