মানুষ সামাজিক
জীব। সমাজস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নৈতিকতার প্রশ্ন উঠে। মানুষের সমাজে সুস্থভাবে জীবনযাপনের এবং নিজের মঙ্গল ও অপরের
মঙ্গল সাধনের জন্য কতকগুলো অধিকারের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু, ‘অধিকার’ শব্দটি
শর্তসাপেক্ষ। সমাজ সদস্যদের ব্যক্তিগত কল্যাণ ও সমাজের
কল্যাণের নিমিত্ত কতকগুলো অধিকার দান করে। মানুষের নিজের জন্য কোন অধিকার নেই। সমাজই তাকে সামাজিক কল্যাণের জন্য কতিপয়
অধিকার মঞ্জুর করে থাকে।
অধিকার কি
প্রত্যেক ব্যক্তির
আত্মোপলব্ধির জন্য কতকগুলো নৈতিক অধিকার আছে। এ অধিকারসমূহ যাতে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখাও তার
কর্তব্য। সমাজ থেকে ব্যক্তি যেমন কতকগুলো অধিকার পায়, তেমনি এসব অধিকারের বিনিময়ে তাকে আবার কতকগুলো 'কর্তব্য পালন করতে হয়। তাহলে
দেখা যায়, অধিকার ও কর্তব্য পারস্পরিক সম্বন্ধে আবদ্ধ। যেখানে অধিকার আছে, সেখানে কর্তব্যবোধও আছে। অধিকার আছে অথচ
কর্তব্য নেই এমন হয় না।
অধিকার কাকে বলে
বিভিন্ন দার্শনিক
অধিকার সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে তাঁদের কয়েকটি সংজ্ঞা উল্লেখ
করা হলো।
Gilehrist এর মতে, "Rights arise from the
fact that man is social and political being."
Bosanauet এর মতে, “অধিকার হলো সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্র কর্তৃক প্রযুক্ত দাবি।”
Prof. Laski এর মতে, “বস্তুত অধিকার হলো সমাজ জীবনের
সেসব অবস্থা, যেগুলো ছাড়া কোন মানুষ সাধারণভাবে তার ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বা পরিপূর্ণ বিকাশে সচেষ্ট হতে পারে
না।” অধিকার মূলত সমষ্টিগত ও কল্যাণকামী।
তাই আদর্শবাদী
দার্শনিক T.H. Green বলেছেন, “সমষ্টিগত নৈতিক কল্যাণ সম্পর্কে চেতনা ছাড়া অধিকারের অস্তিত্ব
অসম্ভব।”
Hob House এর
মতে, “প্রকৃত অধিকার বলতে সামাজিক কল্যাণসাধনের কতকগুলো শর্তকে বুঝায় এবং বিভিন্ন
অধিকারের বৈধতা সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি বিধানের উপর নির্ভরশীল।" .
Barker এর মতে,
“অধিকার হলো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সেসব সুযোগ সুবিধা, যা রাষ্ট্র কর্তৃক
স্বীকৃত ও সংরক্ষিত।"
অতএব, উপর্যুক্ত
সংজ্ঞাসমূহের আলোকে বলা যায় যে, পরিপূর্ণ অর্থে অধিকার হলো প্রত্যেক ব্যক্তির বা সমষ্টির
ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত সুযোগ সুবিধা। অর্থাৎ
কোন সুযোগ সুবিধা দুটি শর্তপূরণ করলে তা অধিকার
হিসেবে গণ্য হয়। যথা : ১. সুযোগ সুবিধা প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক হবে
এবং ২. রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হবে।
পরিশেষে বলা
যায় যে, অধিকার হচ্ছে মানুষের প্রধান উপায়। অধিকার ছাড়া কোন মানুষ সমাজে সুষ্ঠুভাবে বসবাস করতে পারে না। অধিকার শব্দটিকে
মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করলেও নীতিবিদ্যায় নৈতিক অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো
অধিকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। মানবিক বিধিবিধান
বা মূল্য লঙ্ঘনের অর্থই হলো মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। নৈতিক অধিকার সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে নীতিবিদ্যায়
তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
অধিকার কত প্রকার ও কি কি
নীতিবিদ্যার আলোচনায় অধিকার
নামক শব্দটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। উইলিয়াম
লিলি অধিকারের সংজ্ঞা দিয়ে বলেন, “আইনসংগত বা নৈতিক
ভিত্তির উপর নির্ভর করে কোন কিছু পাবার বা কোন নির্দিষ্ট পন্থায় কাজ করার যুক্তিসম্মত দাবিকে অধিকার বলা হয়।" তাই অধিকার
শব্দটিকে আমরা মোটামুটিভাবে এমন একটি প্রস্তাব (Proposal) বলে গণ্য করতে পারি, যা একটা সমাজ বা রাষ্ট্রের অপর কাউকে
আঘাত না করে তাকে বাঁচতে দেওয়ার অধিকার।
অধিকারের শ্রেণীবিভাগ
অধিকার প্রধানত দুই প্রকার।
১. আইনসংগত অধিকার
আইনসংগত অধিকারের সংরক্ষণ ও লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিচাঁরালয়ের আইনের সাহায্য নেওয়ার প্রশ্ন উঠে।
২. নৈতিক অধিকার
পক্ষান্তরে, নৈতিক অধিকার রাষ্ট্র বা বিচারালয়ের আইনের বলে অর্জিত হয় না। নৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সমাজের এমন ধরনের কোন বাইরের নিয়ন্ত্রণ নেই। আইনসংগত অধিকারের চেয়ে নৈতিক অধিকারই নীতিবিদ্যার আসল আলোচ্যবিষয়।
মানুষের এ নৈতিক অধিকার দুটি
শর্তের অধীন। যথা,
- ১. সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তির বিনা বাধায় তার অধিকার ভোগ করার ক্ষমতা রয়েছে। এবং,
- ২. প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে তার
অধিকারকে নিজের ও সমাজের অপরাপর ব্যক্তির কল্যাণে সঠিকভাবে ব্যবহার করা উচিত।
উল্লিখিত এ দুটি শর্তের বাইরে
কারো কোন অধিকারকে সমাজ স্বীকার করে নেয় না। আর যে অধিকার সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত নয়, তা অধিকারের পদবাচ্য
নয়।
মানুষের প্রধান কয়েকটি অধিকার
মানুষের এ মুখ্য অধিকারগুলো (Human Rights) সম্পর্কে নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো। মানুষের প্রধান কতকগুলো অধিকার রয়েছে, যেমন-
১. বাঁচার অধিকার : মানুষের
অধিকারগুলোর মধ্যে বাঁচার অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক । নৈতিকতার আদর্শ
সম্পর্কে যেসব মতবাদ রয়েছে
তাদের সমর্থকেরা মনে করেন যে নৈতিক আদর্শের বাস্তবায়ন জীবন্ত মানুষের ক্ষেত্রে
উঠে এবং সে হিসেবে মানুষকে প্রথমে বাঁচার
মতো বাঁচার অধিকার দিতে হয়। সুস্থ সমাজে জীবনযাপন করার অধিকার মানুষ যদি না পায়,
তাহলে নৈতিকতা বা নৈতিক প্রগতি ব্যাহত হয়,
ফলে ব্যক্তি যেমন নিজের কল্যাণসাধন করতে পারে না, তেমনি সে সমাজের সার্বিক কল্যাণসাধন করতেও অক্ষম হয়। বাঁচার অধিকার না থাকলে
সমাজের সার্বিক কল্যাণসাধন করা কখনো সম্ভব নয়।
২. কাজ করার অধিকার :
মানুষের কাজ করার অধিকার তার বাঁচার অধিকারের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাঁচার
অধিকারের স্বীকৃতির মধ্যেই
তার কাজ করার অধিকার নিহিত। মানুষের প্রাণে বাঁচতে হলে তার খাদ্য, বস্ত্র, আহার্য
ইত্যাদি যোগাড় করতে হয়, আর এগুলো
যোগাড়ের জন্য তাকে কাজ করার অধিকার দিতে হয়।
৩. স্বাধীনতার অধিকার : স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের আর
একটি মৌলিক অধিকার। ইচ্ছা স্বাধীনতার অভাবে নৈতিকতার প্রশ্ন নিরর্থক হয়ে উঠে। ইচ্ছার স্বাধীনতা
নৈতিকতার সাথে নিগূঢ়ভাবে সম্পর্কিত। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মাধ্যমেই মানুষ তার আত্মোলব্ধি
বা কল্যাণ অর্জন করতে পারে। অপরের নির্দেশে কাজ করলে
ব্যক্তির মধ্যে নৈতিকতার স্ফুরণ সম্ভব হয় না তাই নৈতিকতার জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন।
৪. সম্পত্তির অধিকার : কাজ করার অধিকার থেকে যেমন
মানুষের স্বাধীনতার অধিকার নিঃসৃত হয়, তেমনি স্বাধীনতার অধিকার থেকেই মানুষের সম্পত্তির অধিকার
নিঃসৃত হয়। মানুষের নৈতিকতার জন্য যেমন তার স্বাধীনতা প্রয়োজন, তেমনি সম্পত্তির
অধিকারও মানুষের জীবনের স্বাধীন বিকাশের সম্ভাব্যতা
সংরক্ষণের পন্থা হিসেবে প্রয়োজনীয়। মানুষ তার কায়িক ও মানসিক শ্রমের
বিনিময়ে যে সম্পত্তি অর্জন করে তাকে স্বাধীনভাবে ভোগ
করার অধিকার তাকে দিতে হয়।
৫. শিক্ষার অধিকার : আধুনিক সমাজে প্রত্যেক মানুষের
শিক্ষা লাভের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। প্রত্যেক মানুষের সামর্থ্যনুযায়ী সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণের
অধিকার রয়েছে। কেননা মানুষকে বাঁচতে হলে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায়
না। উপযুক্ত শিক্ষার কারণে মানুষ একদিকে
যেমন নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়, অপরদিকে তেমনি অপরের কল্যাণ কামনায় ও নিজেকে
নিয়োজিত করতে সক্ষম হয়। তাই নিজেরও সমাজের সার্বিক
কল্যাণসাধনের জন্য শিক্ষার অধিকার খুবই প্রয়োজনীয়।
৬. চুক্তির অধিকার : সমাজে বসবাস করতে হলে চুক্তির
অধিকার থাকা খুবই প্রয়োজনীয়। সম্পত্তি থাকলে তাকে রক্ষা করার বা কাজ করার অধিকারের জন্য চুক্তি
খুবই আবশ্যক। চুক্তি সম্পাদনের ফলে অনৈতিক অধিকারগুলো অবলুপ্ত হয়, যদি সে চুক্তি
যৌক্তিক বা নৈতিক হয়। আদিম অসভ্য সমাজে মানুষের চুক্তি
সম্পাদনের কোন অধিকার ছিল না এবং সামাজিক প্রগতির ফলে মানুষের অন্যান্য অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে চুক্তির অধিকারও স্বীকৃত
হয়, যাতে মানুষ যুক্তিসম্মতভাবে এ অধিকারকে সার্বিক কল্যাণে ব্যবহার করতে পারে।
ব্যক্তির এ অধিকারগুলো নিজের
এবং সমাজের সার্বিক কল্যাণের জন্য দেওয়া হয়ে থাকে। তাই এ অধিকারগুলো নিজের কল্যাণের সঙ্গে সঙ্গে সার্বিক
কল্যাণের দিকে নিয়োজিত করতে ব্যক্তি
নৈতিকতার দিক থেকে বাধ্য থাকে।
অধিকার ছাড়া কোন মানুষ সমাজে সুষ্ঠুভাবে বসবাস করতে পারে না। অধিকার শব্দটিকে মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করলেও নীতিবিদ্যায় নৈতিক অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলোর অধিকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে। মানবিক বিধিবিধান বা মূল্য লঙ্ঘনের অর্থই হলো মানুষকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। নৈতিক অধিকার সম্পর্কে যে আলোচনা করা হয়েছে নীতিবিদ্যায় তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
0 মন্তব্যসমূহ