বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়, সম্পদের পরিমাণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় লক্ষ করলে বুঝা যায়, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা থাকার পরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে কিংবা যতটুকু সাফল্য অর্জন করা প্রত্যাশিত ছিল তা পূরণ করতে পারেনি। বাংলাদেশ তার নিজস্ব সম্পদ, মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে জনগণের জীবনমান উন্নত করে বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে তুলে ধরার সার্থকতায় প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ।
বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ - সপক্ষে যুক্তিসহ ব্যাখ্যা
বাংলাদেশ তার সম্পদ, জনসাধারণের
কর্মক্ষমতা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে দেখিয়েছেন বাংলাদেশ
একটি উন্নয়নশীল দেশ। নিম্নে এ সম্পর্কে যুক্তি তুলে ধরা হলো।
১. জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি
উন্নয়নশীল দেশের প্রধান বৈশিষ্ট্য
জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত জনসংখ্যা। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা
প্রায় ১৬ কোটি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭%, যা উন্নয়নশীল বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাছাড়া বাংলাদেশের আয়তন, সম্পদের
পরিমাণ ও চাহিদা পূরণের সক্ষমতার চেয়ে জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ বলা যায়।
২. কৃষির ওপর অত্যধিক চাপ
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ন্যায়
বাংলাদেশও কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু জনসংখ্যার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ও জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় চাহিদা পূরণের জন্য
কৃষির ওপর অত্যধিক চাপ পড়ছে, যা আমাদের ভবিষ্যতের
জন্য ক্ষতিকর। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০% মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
তাছাড়া মাথাপিছু জমির পরিমাণ মাত্র ০.২ একর,
যা উন্নয়নশীলতার বড় প্রমাণ।
৩. মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু
আয় উন্নত দেশের চেয়ে অনেক কম। স্বল্প আয়ের কারণে এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক কমে যাচ্ছে। তাছাড়া
তারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, আমিষ গ্রহণ ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে একটি দেশের
উন্নয়নশীলতা বুঝা যায়। সেদিক থেকে বলা যায় বাংলাদেশ
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত।
৪. শিল্পের অগ্রযাত্রা কম
কোন দেশ কতটা অগ্রগতি হচ্ছে তা
বুঝা যায় সেদেশের শিল্পের প্রসারের ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শিল্পের অবদান খুবই কম। তাছাড়া শ্রমের
সহজলভ্যতা অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। আর শিল্পের প্রসার না ঘটায় বেকারত্বের হার বেড়েছে।
উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক কম হচ্ছে। রপ্তানির
চেয়ে আমদানি বেশি হওয়ায় অর্থনীতি অনেক চাপে পড়ছে। শিল্পের নিম্ন অগ্রযাত্রাই উন্নয়নশীলতার
পরিচয় বহন করে।
৫. উৎপাদনশীলতার স্বল্পতা
দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর
করে উৎপাদনশীলতার ওপর। উৎপাদন বাড়লে অর্থনীতি চাঙা হয় আর কম হলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ
ভূমি ব্যবস্থা উন্নত উপকরণের অভাব, উন্নত চাষ পদ্ধতি, বীজ, সার ইত্যাদির অভাবে উৎপাদন কম হয়। তাছাড়া অনেক এলাকা
আধুনিক সেচ ব্যবস্থার আওতায় না আসায় চাষাবাদ
কম হচ্ছে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা উৎপাদন কমার অন্যতম কারণ।
৬. মূলধনের অপর্যাপ্ততা
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় কম হওয়াই সঞ্চয়ও
কম হয়। এদেশের রিজার্ভ চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়। মূলধনের অপর্যাপ্ততার কারণে আর্থসামাজিক উন্নয়ন
বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরকারি বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। ফলে অন্যান্য অগ্রগতি প্রত্যাশিত অনুযায়ী সাফল্য পাচ্ছে না।
প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় জনগণ তার সুফল পাচ্ছে না।
৭. বেকারত্বের ঊর্ধ্বগতি
উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার কারণে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে
ভারসাম্য বজায় রাখা অনেক সময় সম্ভব হয় না। তার ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় দিন দিন বেকারত্বের
হার বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। প্রতিবছর এর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশ বেকারত্বের
হার কমানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু
তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বেকারত্বের হার দেখেই অনুমান করা যায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল
দেশ।
৮. সাক্ষরতার হার কম
বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার উন্নত দেশের তুলনায় অনেক
কম। শতকরা মাত্র ৬৩.৬% মানুষ সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। বাকি মানুষ অশিক্ষিত হওয়ায় তারা তাদের জীবনমান উন্নয়নে
তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। উন্নত দেশের সাক্ষরতার
হার ১০০% এর কাছাকাছি। সাক্ষরতার হারই নির্ণয় করে বাংলাদেশের উন্নয়নশীলতা।
৯. যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব
দেশের রেলপথ, বিমানপথ, সড়ক পথ, নৌপথের নাজুক অবস্থা
দেশের অবকাঠামোর দুর্বল চিত্র
ফুটে ওঠে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ওপর একটি দেশের বিনিয়োগ শিল্পের ও ব্যবসা বাণিজ্যের
প্রসার ইত্যাদি অনেকাংশে নির্ভর করে। কিন্তু
বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতির ফলে দেশে শিল্পের প্রসার ঘটছে না। বৈদেশিক বিনিয়োগ কম হচ্ছে, যা উন্নয়নশীল দেশের বাস্তবিক
অবস্থা।
১০. কুসংস্কারাচ্ছন্নতা
বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক, ধর্মীয় রীতিনীতি ও বিশ্বাস
অতি প্রবল। কুসংস্কার, জাতিভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি থাকার কারণে পরিশ্রম না করে ভাগ্য উন্নয়ন ঘটাতে চেষ্টা করে।
কিন্তু তা সম্ভব নয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের
মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষের মাঝেও ঐসব ধ্যানধারণা বিদ্যমান থাকে। কুসংস্কারাচ্ছন্নতার
কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত
হচ্ছে। এ মানসিকতা উন্নয়নশীল দেশের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
১১. ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব
একট। ক্ষমতাসীন দল যেকোনো উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। অপরদিকে, বিরোধী দল ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত
করে ক্ষমতায় যেতে চায়। এ যাওয়ার ও থাকার মাঝে
সংঘাত বাধে। বাংলাদেশের এ বাস্তবতাই উন্নয়নশীল দেশের পরিচয় বহন করে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশ
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জনসংখ্যার বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় নিম্ন, অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈদেশিক
সাহায্যের নির্ভরতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দ্বারা
সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ