বায়ুদূষণ কি
পরিবেশের ভারসাম্য
রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে বায়ু। কিন্তু বায়ু প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে
দূষিত হচ্ছে, যা বায়ুদূষণ নামে পরিচিত। আধুনিক বিশ্বে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে বায়ুদূষণের পরিমাণ দিন দিন
বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বায়ুদূষণ বর্তমান
বিশ্বের পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে অন্যতম। এটি জীবজগতের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশকে চরমভাবে
বাধাগ্রস্ত করে। তাই বায়ুদূষণকে রোধ করার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বায়ুদূষণ কাকে বলে
বিভিন্ন প্রাকৃতিক
ও মানবসৃষ্ট কারণে বায়ুর উপাদানের তারতম্য ঘটলে তাকে বায়ুদূষণ বলে। অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণবশত বা মানুষ সৃষ্টি
কার্যকলাপের দরুন বাতাসে বিদ্যমান কোনো গ্যাসের পরিবর্তনের ফলে মানুষ ও অন্যান্য
জীবজন্তুর ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাকে বায়ুদূষণ
বলে। বায়ু বিভিন্ন গ্যাসের সংমিশ্রণ গঠিত। এর মধ্যে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, আর্গন, কার্বন ডাইঅক্সাইড উল্লেখযোগ্য। অবশিষ্ট
উপাদানগুলো হচ্ছে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ক্রিপটন, জেনন, নিয়ন, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন এবং জলীয়বাষ্প ও ধূলিকণা।
বায়ুর ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণের একটি চরম সহনশীল মাত্রা রয়েছে। বায়ুতে বিদ্যমান উপাদানগুলোর সহজশীল মাত্রার বাইরে চলে গেলে
জীবজগৎ তথা পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
বায়ুদূষণের কারণ, ফলাফল ও নিয়ন্ত্রণের উপায়সমূহের বিবরণ
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বায়ু হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। রাসায়নিক, ভৌতিক ও জৈবিক কারণে পরিবেশের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের যেকোনো পরিবর্তনের রূপ হচ্ছে দূষণ। বায়ু বিভিন্নভাবে দূষিত হয়। আধুনিক বিশ্বে শিল্পায়ন, নগরায়ন ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বায়ু দূষণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জীবজগৎ তথা অজৈব বস্তুর ওপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি পরিবেশের জন্য কাম্য নয়। বায়ুদূষণের যথাযথ কারণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ সম্পর্কে সচেতন হয়ে বায়ুদূষণকে নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি।
বায়ুদূষণের কারণসমূহ
প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানাবিধ
কারণে বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। নিম্নে বায়ুদূষণের কারণসমূহ
আলোচনা করা হলো।
- ১. যানবাহন হতে নির্গত গ্যাস : বিভিন্ন যানবাহন, যেমনঃ বাস, ট্রাক, রেলগাড়ি, লঞ্চ, মোটরগাড়ি, স্টিমার, ইঞ্জিন চালিত নৌকা প্রভৃতি হতে প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হয়। এসব ধোঁয়ায় কার্বন মনোঅক্সাইড (CO), নাইট্রিক অক্সাইড (NO3), সালফার ডাইঅক্সাইড (SO2), হাইড্রোজেন ক্লোরাইড (HCl), হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S) প্রভৃতি যুক্ত থাকে। এগুলো বায়ুকে দূষিত করে এবং জীবকুলের বেশ ক্ষতিসাধন করে।
- ২. ধোঁয়াশা : কলকারখানার চিমনি হতে, যানবাহনের সাইলেন্সের পাইপ হতে, রাস্তা নির্মাণকালে বিটুমিন গলানো হতে সর্বদা ধোঁয়া নির্গত হয় । এসব অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের সাথে মিশে মেঘের ন্যায় ঘন কালো অবস্থার সৃষ্টি করে, তাকে ধোঁয়াশা বলে। বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলে ধোঁয়াশা বেশি সৃষ্টি হয়। এর ফলে বায়ু দূষিত হয়।
- ৩. ধোঁয়া : জ্বালানিসমূহের অসম্পূর্ণ দহনের ফল হলো ধোঁয়া। ধোঁয়া সৃষ্টির ফলে বায়ুদূষণ ঘটে। কলকারখানা, ইটের ভাটা, বাড়িতে রান্নার কাজে ভেজা কাঠ ব্যবহারের ফলে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। পরিবেশ দূষণের শতকরা প্রায় ১০–১৫ ভাগ ধোঁয়ার কারণে হয়ে থাকে।
- ৪. ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (CFC): এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর, প্লাস্টিক ও রং তৈরির কারখানা হতে নির্গত একটি গ্যাস; যাকে ক্লোরোফ্লোরোকার্বন বলা হয়। এ গ্যাস বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে। যার ফলে বায়ু দূষিত হয়।
- ৫. তেজস্ক্রিয় পদার্থ : বর্তমানে বিশ্বের উন্নত দেশ পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার ক্ষেত্রে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। এতে বিষাক্ত উপকরণসমূহ বায়ুতে মিশে বায়ুকে চরমভাবে দূষিত করছে।
- ৬. আয়নিক রশ্মি বিচ্ছুরণ : কতিপয় মৌলিক পদার্থ ধ্বংসের ক্ষেত্রে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিকিরণ ঘটে। এতে স্থিতিশীল পরমাণু হতে ইলেকট্রন নির্গত হয়; যা বাতাসে মিশে বায়ুকে দূষিত করে।
- ৭. কীটনাশক ওষুধের ব্যবহার : কৃষিক্ষেত্র নষ্টকারী পোকামাকড়, আগাছা, ছত্রাক প্রভৃতি বিনাশ করার জন্য এলড্রিন, ক্লোরডেন, ডি. ডি. টি, হেণ্টাক্লোর, টেক্সোফেন, আনসার প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। এসব বিষাক্ত ওষুধের গ্যাস বায়ুতে মিশে বায়ুকে দূষিত করে।
- ৮. আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাত : আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাতের ফলে এর জ্বালামুখ দিয়ে ভূঅভ্যন্তরের গলিত লাভা, ভস্ম, ছাই প্রভৃতি ভূপৃষ্ঠে নির্গত হয়। এতে এর জলীয় অংশ বাতাসে মিশে যায়, ফলে বায়ু দূষিত হয়।
- ৯. মৃত জীব : মৃত উদ্ভিদ অথবা প্রাণী পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলে তাতে পচন ধরে। ফলে তা হতে মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইটি প্রভৃতি গ্যাস উৎপন্ন হয় এবং সেগুলো বায়ুতে মিশে যায়। এতে বায়ু দূষিত হয়।
বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব/ফলাফল
নিম্নে বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ উল্লেখ করা
হলোঃ
- ১. বিভিন্ন রাসায়নিক গ্যাস যা কলকারখানা হতে পরিত্যক্তভাবে নির্গত হয়ে মানবদেহের শ্বাসকষ্ট ও চোখের প্রদাহ ঘটিয়ে থাকে।
- ২. বায়ুতে বিদ্যমান ধুলাবালির সূক্ষ্মকণা ও বিভিন্ন ধাতব কণা মানুষের বিভিন্ন রোগ করে। যেমনঃ অ্যাজমা, কাশি, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি হয়ে থাকে।
- ৩. বায়ুতে অবস্থিত সীসা শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে গ্রহণের ফলে শিশুদের লেখাপড়ার অমনোযোগিতা, অস্থিরতা, বয়স্ক মানুষের স্বাভাবিক কার্যাবলির ব্যাঘাত এমনকি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। বায়ুতে বিদ্যমান সালফার ডাইঅক্সাইড বিভিন্ন উদ্ভিদকুল ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।
- ৪. বায়ুতে বিদ্যমান নাইট্রোজেন ও সালফার অক্সাইড বৃষ্টির সাথে মিশে নাইট্রিক ও সালফিউরিক এসিডে রূপান্তরিত হয়; যাকে এসিড রেইন বলে। এ এসিড রেইন মাটিস্থ পানির pH হ্রাস করে এবং উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায় । এতে অনেক দেশের বনাঞ্চলকে ধ্বংস করে তোলে।
- ৫. কলকারখানা ও ইঞ্জিনচালিত যাবনাহন থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস মানবদেহের শরীরে ঢুকে রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে মিশে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয় ।
- ৬. বিভিন্ন জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহনের ফলে সৃষ্ট হাইড্রোকার্বন যকৃতের ক্যান্সার ঘটায়।
বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় কি কি
বিশুদ্ধ বায়ু পৃথিবীর উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের জন্য
অপরিহার্য। তাই বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব হতে মুক্তি পেতে হলে নিম্নোক্ত কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
যেমন,
- ১. ক্ষতিকর ধোঁয়া যেন যানবাহন হতে নির্গত হতে না পারে সেজন্য যানবাহনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা।
- ২. বায়ু হতে ধোঁয়া ও ধুলাবালি অপসারণের জন্য তড়িৎ অধঃক্ষেপক ব্যবহার করা।
- ৩. বসতি অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলের মধ্যে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখা।
- ৪. ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থকে অন্য কোনো রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে শোধন করা।
- ৫. কীটনাশক ব্যবহার না করে জৈবিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা।
- ৬. সকল প্রকার কলকারখানা হতে ক্ষতিকর গ্যাসের নির্গমন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পরিবেশে
বায়ু অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বর্তমান বিশ্বের পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হলো বায়ুদূষণ। এটি
জীবজগতের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে। ব্যক্তিগত, প্রযুক্তি ও আইনসম্মত উপায়ে
ব্যবস্থা গ্রহণ করে বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণের সার্বিক সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।
0 মন্তব্যসমূহ