সংগঠনের নীতিমালা সমূহ বা নিয়ম নীতি আলোচনা কর

 

সংগঠনের নীতিমালা সমূহ বা নিয়ম নীতি আলোচনা কর

নীতি হল কোন কাজ সম্পাদনের সাধারণ নির্দেশিকা (Guidance for action)। দীর্ঘদিনের কার্য প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সকল ক্ষেত্রেই এমন কিছু নিয়মনীতি গড়ে ওঠে বা গৃহীত হয়। যা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে ঐ কাজ সুচারুভাবে সম্পাদন করা যায়। এ ধরনের নিয়ম বা দিকনির্দেশনাকেই নীতি বলা হয়। কার্যকর সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এমন কিছু নিয়ম বা নীতিমালা লক্ষণীয়।

সংগঠনের নীতিমালাসমূহ বা নিয়ম নীতি

সুষ্ঠু সাংগঠনিক কার্যসম্পাদনের জন্য যেসব আদর্শ অনুসরণ করতে হয় সেগুলোকে সংগঠনের নীতিমালা বা নিয়ম নীতি বলা হয়। সংগঠনের নীতিমালাসমূহ নিম্নে বর্ণনা করা হল।

১. লক্ষ্যের নীতি (Principle of goals)

কার্যকর সংগঠন প্রতিষ্ঠায় একজন সংগঠনকে প্রথমেই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বিবেচনা করতে হয়। লক্ষ্য যেমন হবে সংগঠনকেও সেভাবেই গড়ে তোলা আবশ্যক। এলাকার উন্নয়নে একটা ক্লাব গড়তে যেয়ে সংগঠনকে যেভাবে তৈরি করার প্রয়োজন হয় একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সংগঠনকে সেভাবে গঠন করলে চলে না। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও একটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও এ কারণেই সংগঠন কাঠামোতে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

২. দক্ষতার নীতি (Principle of efficiency)

যে কোন ক্ষেত্রে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় দক্ষতার বিষয়টি সবসময়ই সামনে রাখতে হয়। Weihrich and Koontz বলেছেন, "Efficiency is the achievement of the ends with the least amount of resources." অর্থাৎ, কর্মশক্তি ও উপায় উপকরণ ব্যয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনই হল দক্ষতা। সংগঠনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কার্য প্রবাহের গতিপথ রচিত হয়ে থাকে। যেখানে যেসব বিভাগ খোলা প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব প্রত্যেকের জন্য যেভাবে নির্ধারণ করা উচিত, সম্পর্ককে যেভাবে ঠিক করে দেওয়া আবশ্যক তা যদি করা না যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে যত নিষ্ঠাসহকারে কাজ করা হোক না কেন দক্ষতাসহকারে তা সম্পাদন ও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ সম্ভব হয় না।

৩. শ্রমবিভাজনের নীতি (Principle of division of labour)

প্রতিষ্ঠানের সংগঠন প্রক্রিয়ার প্রথম ও প্রধান কাজ হল প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি ও কাজের ধরন অনুযায়ী কাজগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত ও বিভাজন করা। এর আলোকেই প্রতিষ্ঠানে বিভাগ ও উপবিভাগ খোলা হয় এবং দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নিরপিত হয়। তাই এমনভাবে কার্য বিভাজন করা উচিত, যাতে কাজ করতে গিয়ে প্রত্যেক ব্যক্তি বিশেষ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়।

৪. কাম্য তত্ত্বাবধান পরিসর নির্ণয়ের নীতি (Principle of determining optimum span of supervision)

প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে নিযুক্ত প্রত্যেক নির্বাহি বা ব্যবস্থাপকগণ প্রত্যক্ষভাবে কতজন অধস্তনের কাজ তত্ত্বাবধান করবেন তা সংগঠন কাঠামোতে নির্দিষ্ট করা হয়। এক্ষেত্রে একজন নির্বাহির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এমন পরিমাণ নির্বাহির সংখ্যা নির্দিষ্ট করা উচিত যাতে তার পক্ষে অধস্তনদের কাজ সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করা যায়। এ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের উপরিস্তরে তত্ত্বাবধান পরিসর ছোট এবং নিচের দিকে তত্ত্বাবধান পরিসর কিছুটা বড় রাখতে হয়।

৫. জোড়া-মই শিকলের নীতি (Principle of scalar chain)

নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী সংগঠনে জোড়া-মই শিকলের নীতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রত্যেক বিভাগ, উপবিভাগ ও ব্যক্তির কাজকে এমনভাবে একে অন্যের সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় যাতে কেউই এর বাইরে না থাকে। এরূপ শিকল প্রতিষ্ঠার ফলে এর বাস্তবায়ন সহজ হয় এবং দলীয় প্রচেষ্টা জোরদার হয়।

৬. দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণের নীতি (Principle of defining specific responsibility)

প্রতিটি সংগঠনে কর্মরত প্রত্যেক কর্মীর নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকা আবশ্যক। প্রত্যেকেই যেন জানতে পারে তার দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের সীমা কতদূর। প্রতিষ্ঠানের উপরিস্তরের নির্বাহিদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বেশি হয় এবং ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে তা কম হতে থাকে। এতে ঊর্ধ্বতন অধিক কর্তৃত্বশালী হয়। ফলে সে যেমনি অধস্তনদেরকে জবাবদিহি করাতে পারে তেমনি নিজেও জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে।

৭. কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের সমতার নীতি (Principle of conformity between authority and responsibility)

একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপকদের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের মধ্যে সমতা বিধান করা অপরিহার্য। কর্তৃত্ব বেশি অথচ দায়দায়িত্ব কম থাকলে ব্যবস্থাপক সাধারণভাবে স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে। আবার দায়িত্ব বেশি অথচ কর্তৃত্ব কম হলে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর হয় না। একজন নিরীক্ষককে হিসাব নিরীক্ষার দায়িত্ব দিলে অবশ্যই তাকে খাতাপত্র দেখানো বা তলব করার কর্তৃত্ব দেওয়া উচিত।

৮. আদেশের ঐক্যের নীতি (Principle of unity of command)

প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটি স্তরে আদেশের ঐক্য যাতে বজায় থাকে অর্থাৎ একজন অধস্তনের যাতে প্রত্যক্ষভাবে একজন মাত্র আদেশকর্তা (Boss) থাকে, কার্যকর সংগঠন প্রতিষ্ঠায় সে বিষয়টি বিশেষভাবে নজর রাখতে হয়। একাধিক আদেশ দাতা থাকলে দ্বৈত অধীনতার সৃষ্টি হয় এবং সে অবস্থায় অধস্তনের পক্ষে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। Joseph L. Massie বলেছেন, "Unity of command, states that no member of an organization should report to more than one superior on any single function." অর্থাৎ, আদেশের ঐক্য হল প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মীই তার একক কাজের জন্য একাধিক ঊর্ধ্বর্তনের কাছে রিপোর্ট করবে না।

৯. সারল্য ও সুস্পষ্টতার নীতি (Principle of simplicity and clarity)

সংগঠন এমন হওয়া আবশ্যক যাতে তা সহজ ও সরল হয়। এরূপ সংগঠন কাঠামো দেখে সংগঠনের ভিতরে ও বাইরের যে কেউ যেন এর স্তরবিন্যাস, কর্তৃত্ব রেখা এবং জনশক্তি ও বিভাগ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। তাই এমনভাবে সংগঠন কাঠামো গড়ে তোলা উচিত যাতে তা জটিল না হয় এবং প্রত্যেকেই তার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সম্পর্কে এবং তাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে। তাছাড়া প্রত্যেক ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট হওয়া আবশ্যক ।

১০. ভারসাম্যের নীতি (Principle of balance)

সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এর প্রতিটি ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগের কাজের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করা আবশ্যক। এমন যেন না হয় কেউ অধিক কর্মভারগ্রস্ত এবং কারও কাজ নেই। এ অবস্থা হলে প্রতিষ্ঠানের কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কোন বিভাগের কাজ বেশি হলে সেখানে জনবল বাড়িয়ে কার্যক্ষেত্রের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

১১. নমনীয়তার নীতি (Principle of flexibility)

সংগঠনের নমনীয়তা বজায় রাখা আরেকটি অন্যতম মূলনীতি। প্রয়োজনে যাতে কোন নতুন বিভাগ বা উপবিভাগ খোলা যায় এবং প্রয়োজনে কোন বিভাগ বন্ধ করা যায় সে ধরনের ব্যবস্থা সংগঠন গড়ার সময় সংগঠকের নজরে থাকা আবশ্যক। তাই কোন বিভাগ বা উপবিভাগ তাড়াহুড়া করে না খুলে এডহক ভিত্তিতে তা খুলে এর ফলাফল মূল্যায়ন করা যেতে পারে। মূলত ভবিষ্যতে উদ্ভূত সাংগঠনিক জটিলতা দূর করার জন্য নীতিমালা অবশ্যই নমনীয় হওয়া উচিত।

১২. নেতৃত্বের নীতি (Principle of leadership)

সংগঠন এমনভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে এর বিভিন্ন স্তরের নির্বাহিরা কার্যকর নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ পায়। কর্তৃত্ব এমন মাত্রায় প্রদান করা উচিত যাতে তা অধস্তনদেরকে উৎসাহিত করে আবার ঊর্ধ্বতনদের কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন না হয়। অধস্তনদেরকে দেওয়া কর্তৃত্ব যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে প্রয়োগ করতে পারে তারও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকা উচিত। স্বস্থানে তারা যাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে সংগঠনে তারও ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। এতে কার্যকর নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

১৩. ব্যতিক্রম নীতি (Principle of exception)

ব্যতিক্রম নীতি বলতে প্রতিষ্ঠানের যেসব কাজ ব্যতিক্রমধর্মী অর্থাৎ যেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে বা কাজ একটু ভিন্ন প্রকৃতির অথবা যেখানে কাজে সমস্যা হলে তা প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কাজে অধিক সমস্যার সৃষ্টি করে, সেসব কাজে অধিক মনোযোগী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টিকে বুঝায়। এজন্য সংগঠন কাঠামো প্রণয়নের সময় এসব কাজকে পৃথকভাবে নির্দিষ্ট করে তার কর্তৃত্ব বা তদারকি ঊর্ধ্বতনের অধীনে রাখা আবশ্যক। এরূপ নীতির ফলে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যে গতিশীলতা আসে এবং নিয়ন্ত্রণ কার্য সঠিকভাবে সমাধান করা যায়।

১৪. বিশেষায়নের নীতি (Principle of specialization)

বর্তমানকালে কাজের সফলতা অর্জনে প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। বিশেষায়ন বলতে কাজকে সুষ্ঠুভাবে বিভাজন করে একজন নির্দিষ্ট কর্মীর জন্য একটি কাজ নির্দিষ্ট করাকে বুঝায়, যাতে সে একই ধরনের কাজ করতে গিয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায়। সংগঠনের সমগ্র কাঠামো এমন কতিপয় কার্যাবলিতে ভাগ করতে হবে যেন তারা দক্ষতার সাথে প্রতিষ্ঠানের সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।

১৫. শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার নীতি (Principle of order and discipline)

শৃঙ্খলার নীতি বলতে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত প্রত্যেক কর্মী ও উপকরণের জন্য কাজ ও স্থান এমনভাবে নির্দিষ্ট করাকে বুঝায়, যাতে প্রত্যেকে স্ব-স্ব স্থানে কর্মরত থাকে। কে কোথায় কাজ করবে তা সঠিকভাবে কাজ নির্দিষ্টকরণ (Job specification) এর মাধ্যমে ঠিক করা হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুবর্তিতা যাতে বজায় থাকে সেজন্য সাংগঠনিক কাঠামোতে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা এমনভাবে বিন্যস্ত করা উচিত। যাতে ঊর্ধ্বর্তন ও অধস্তনকে সঠিকভাবে জবাবদিহি করতে হয়।

উপসংহার

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কার্যকর সংগঠন সৃষ্টির ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন নির্বাহিদের উল্লিখিত নীতিমালা বিশেষভাবে অনুসরণ করা উচিত। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ ফলপ্রসূতা অর্জনে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। উপরালোচিত নীতিমালার আলোকে সংগঠন তৈরি করা হলে তা শক্তিশালী, গতিশীল ও ফলদায়ক হবে এবং প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যসম্পাদন সহজসহ উদ্দেশ্যার্জন ত্বরান্বিত হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ