পৰ্বত কী
পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বত্র সমান নয়। এর কোথাও সুউচ্চ পর্বত, কোথাও
মালভূমি আবার কোথাও বিস্তৃত সমতল ভূমি রয়েছে। পৃথিবী পৃষ্ঠের
বিভিন্ন স্থানের ভূমিরূপে বিভিন্ন ধরনের। এ বৈচিত্র্যেময় ভূমিরূপের একটি অন্যতম
ধরুন হলো পর্বত। যা পাহাড় থেকে বহুদূর বিস্তৃত ও উঁচু।
ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত পর্বতগুলোর মধ্যে উচ্চতা ও আকৃতিগত দিক দিয়ে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। পর্বতমালার অবস্থান ভূপৃষ্ঠের
বন্ধুরতাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েছে।
পর্বত কাকে বলে
সাধারণত ৬০০-১০০০ মিটার উঁচু বিস্তৃত শিলাস্তূপকে পাহাড় বলে। আর সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সুউচ্চে অবস্থিত ১০০০ মিটারের বেশি উঁচু বিস্তৃত শিলাস্তূপকে পর্বত বলে, যা খাড়া ঢালবিশিষ্ট হয়ে থাকে। পর্বত হচ্ছে পৃথিবীপৃষ্ঠের সবচেয়ে উচ্চভূমি। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের অতি উচ্চ, সুবিস্তৃত এবং খাড়া ঢালবিশিষ্ট শিলাস্তূপকে পর্বত বলে। পার্শ্ববর্তী এলাকার তুলনায় আংশিক খাড়া চালবিশিষ্ট এবং ভূপৃষ্ঠ হতে ১০০০ মিটারের অধিক উচ্চতাসম্পন্ন স্থানই পর্বত।
পর্বতের উদাহরণ
হিমালয়, আল্পস, রকি, আন্দিজ, উরাল প্রভৃতি হলো পর্বত। এ পর্বতগুলো
সাধারণত ভূঅভ্যন্তরে প্রবল ভূআলোড়ন, শিলার ক্ষয় ও সঞ্জয়কার্য, শিলাস্তরের টান
প্রভৃতির ফলে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তরে ভূঅধঃর্ভাজের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়।
পর্বত সৃষ্টির প্রক্রিয়া
আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহের ইতিহাস হতে জানা যায় যে, পৃথিবীর বাহিরের
আবরণ সর্বপ্রথম ঠান্ডা হয়ে অশ্মমণ্ডলে রূপ নেয়।
ঠান্ডা হওয়ার সময় এর বিভিন্ন স্তর সংকুচিত হয়। এ সংকোচনের পরিমাণ সবজায়গায়
সমানভাবে হয় না। ভূগর্ভস্থ তাপ বিকিরণের প্রভাবে সংকোচনের
মাধ্যমে পৃথিবীপৃষ্ঠ কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু ভাঁজ পড়ে এবং বিকিরণের কারণে পার্শ্বচাপের সৃষ্টি হয়। আর
এরূপ প্রক্রিয়ায় পর্বতের সৃষ্টি হয়। পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস পর্যালোচনায় আরও জানা যায় যে, বিভিন্ন স্থানে দুটি
পুরাতন শিল্ড (Block) বা শক্ত ভূখণ্ড প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ দ্বারা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এদের মধ্যবর্তী
স্থানে বিশেষ করে সমুদ্র তলদেশে ব্যাপক সময় ধরে হাজার হাজার ফুট পাললিক শিলাস্তর সৃষ্টি এবং শিলাস্তর ক্রমশ ধীরে ধীরে
নিচের দিকে বসে যায় এবং ভূঅধঃর্ভাঁজ সৃষ্টি হয়। ভূঅধঃর্ভাঁজ সম্পর্কে কোবার বলেন, দুটি বৃহদাকার মহাদেশীয় ভূখণ্ড
(Foreland) এর মধ্যবর্তী স্থানে ভূনিম্ন মহীখাতের সৃষ্টি হয়। উক্ত ভূখণ্ডদ্বয় ক্রমাগত ক্ষয়কার্যের ফলে মহীখাতে পর্যায়ক্রমে
পলি সঞ্চিত হতে থাকে। পলি সঞ্চয়নের পরিমাণ অব্যাহত থাকায় নিচের সঞ্চিত পলিতে চাপের সৃষ্টি হয় এবং মহীখাত সংযুক্ত
Foreland দুটিতে টান পড়ে; যা পরস্পরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারপর Foreland বা মহাদেশীয় ভূখণ্ডদ্বয়ের অনুভূমিক
চাপের ফলে অবনমিত নরম শিলা সংকুচিত ও কোঁকড়ানোর মাধ্যমে উপরে উদিত হয় এবং পর্বত সৃষ্টি করে। এছাড়াও ভূঅভ্যন্তরে
বিভিন্ন ধাতব ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ বিদ্যমান। এগুলো সর্বদা তাপ বিকিরণ করে প্রচণ্ড উত্তাপের সৃষ্টি করে। পাশাপাশি
ভারসাম্য রক্ষার্থে সেখানে পরিচলন স্রোতের সৃষ্টি হয়। এতে প্রবল শক্তির সৃষ্টি হয়, যা পার্শ্ব ও ঊর্ধ্ব উভয়দিকে কাজ
করে। যার ফলে ভূপৃষ্ঠ কখনও নিচে বসে যায় অথবা কখনও উত্থিত হয় অথবা কখনও এর কিছু অংশ হেলে পড়ে। এতে করে শিলান্তরের
মধ্যে ভাঁজের সৃষ্টি হয়, যা গিরিজনি আলোড়নের ফলে সৃষ্ট। এ সম্পর্কে জার্মান ভূগোলবিদ কোবার বলেন, “ভূঅধঃভাঁজ
হতে পর্বত সৃষ্টি।”
পর্বতের শ্রেণিবিভাগ
ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত পর্বতগুলোর গঠনপ্রণালি ও বিন্যাস একেক ধরনের। তাই গঠন ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পর্বতকে কয়েকটি ভাগে ভাগে করা যায়। নিম্নে পর্বতের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো।
১. ভঙ্গিল বা ভাঁজ পর্বত
সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী ছিল অতিশয় উত্তপ্ত ও গ্যাসীয় পিণ্ড। এ পিণ্ড ধীরে ধীরে তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে বর্তমান কঠিন অবস্থায় পৌঁছে। ভূপৃষ্ঠের তুলনায় ভূঅভ্যন্তরভাগের তাপমাত্রা অত্যধিক। অভ্যন্তরীণ উত্তাপের ফলে ভূগর্ভে আলোড়ন বা কম্পন সংঘটিত হয়। আর এ কারণে ভূপৃষ্ঠের বিশেষ কিছু অংশ কখনও বসে যায় আবার কখনও উত্থিত হয়। এতে শিলাস্তরে ভাঁজ পড়ে। যান্ত্রিক ক্ষয়সাধনের কারণে উঁচু স্থান হতে ক্ষয়প্রাপ্ত পদার্থগুলো বের হয়ে কোনো নিচু স্থান বা সমুদ্রগর্ভে পলিরূপে স্তরে স্তরে সঞ্চিত হতে থাকে। কালক্রমে উক্ত পলি জমাট বেঁধে কোমল পাললিক শিলাস্তর গঠন করে। ভূআলোড়নের ফলে এতে অনুভূমিক পার্শ্বচাপের সৃষ্টি হয়। যার দরুন উক্ত পাললিক শিলাস্তরে উঁচু-নিচু হয়ে ভাঁজ পড়ে, যা সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায় আকার ধারণ করে। এরূপ সুউচ্চ ভাঁজসমূহকে ভঙ্গিল পর্বত বা ভাঁজ পর্বত বলে। অর্থাৎ ভাঁজের ফলে যে পর্বত গঠিত হয় তাকে ভঙ্গিল বা ভাঁজ পর্যন্ত বলে। ভঙ্গিল পর্বত সৃষ্টির পিছনে তিনটি কারণ বা প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তাহলো-
- ক. পরিচলন স্রোতের প্রভাব,
- ঘ. সংকোচনের প্রভাব ও
- গ. পলিস্তর
ভঙ্গিল পর্বতের চিত্র |
ভঙ্গিল পর্বতের বৈশিষ্ট্যসমূহ
i. ভঙ্গিল পর্বত ভাঁজবিশিষ্ট হয়ে থাকে।ii. এ পর্বতে অনেক শৃঙ্গ বিদ্যমান ।
iii. এ পর্বত স্তরযুক্ত কোমল পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত।
iv. এরূপ পর্বতের শিলার মধ্যে সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবাশ্ম দেখা যায়।
v. পৃথিবীর দীর্ঘ ও উচ্চতম পর্বতগুলো এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
vi. এটি পাহাড় থেকে অতিশয় উঁচু ও বিস্তৃত হয়ে থাকে।
vii. এতে দীর্ঘ চ্যুতিরেখা দেখা যায়।
ভঙ্গিল পর্বতের উদাহরণ
এশিয়ার হিমালয়, ইউরোপের আগ্লাস, উত্তর আমেরিকার রকি, দক্ষিণ আমেরিকার
আন্দিজ প্রভৃতি।
২. স্তূপ পর্বত
প্রচণ্ড ভূআলোড়ন বা ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বক অনুভূমিক চাপের কারণে এর কোনো কোনো অংশের শিলাস্তর খাড়াভাবে ফেটে গিয়ে একদিকের শিলাস্তর পার্শ্ববর্তী শিলাস্তর হতে স্থানচ্যুত হলে তাকে চ্যুতি বলে। আর দুটি চ্যুতির মধ্যবর্তী শিলাস্তর ঊর্ধ্বচাপ বা পার্শ্বচাপের ফলে উপরের দিকে উঁচু হয়ে অথবা পার্শ্ববর্তী শিলাস্তর নিচে বসে গিয়ে মধ্যবর্তী অংশটি স্তূপাকারে উঁচু হয়ে যে ভূমিরূপ গঠন করে তাকে স্তূপ পর্বত বলে।
স্তূপ পর্বতের চিত্র |
স্তূপ পর্বতের বৈশিষ্ট্যসমূহ
i. স্তূপ পর্বত ধীরে ধীরে উঁচু হয় না বলে এর পার্শ্ববর্তী ঢাল খুব খাড়া হয়।ii. এ পর্বতের শৃঙ্গ থাকে না ।
iii. এ পর্বতের চূড়া চ্যাপ্টা আকৃতির।
iv. এ জাতীয় পর্বত স্বল্প অঞ্চলব্যাপী অবস্থান করে।
স্তূপ পর্বতের উদাহরণ
জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট, পাকিস্তানের লবণ পর্বত, দাক্ষিণাত্যের
নীলগিরি পর্বত প্রভৃতি।
৩. সঞ্চয়জাত বা আগ্নেয় পর্বত
ভূগর্ভে প্রবল আলোড়নের ফলে যে চাপ সৃষ্টি হয় তাতে ভূত্বকের দুর্বল
অংশ বা ফাটল দিয়ে উত্তপ্ত গলিত লাভা নির্গত হয়। এসব লাভায় ধাতব পদার্থ,
ভস্ম, বালু, কাকর ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ ও গ্যাস মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। বাইরেও বাতাসের সংস্পের্শে এসব পদার্থ শীতল
হয়ে শঙ্কুর আকৃতি ধারণ করে যে পর্বত গঠিত হয় তাকে সঞ্চয়জাত পর্বত বলে। আগ্নেয় পদার্থসমূহ সঞ্চিত হয়ে এ প্রকার পর্বত গঠিত
হয় বলে একে আগ্নেয় পর্বতও বলে।
সঞ্চয়জাত বা আগ্নেয় পর্বতের চিত্র |
সঞ্চয়জাত বা আগ্নেয় পর্বতের বৈশিষ্ট্যসমূহ
i. আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এ পর্বতের সৃষ্টি।ii. এ জাতীয় পর্বতের আকৃতি মোচার মতো।
iii. এ পর্বতের উচ্চতা ও ঢাল মাঝারি ধরনের।
iv. এ পর্বত আগ্নেয় পদার্থ দ্বারা গঠিত।
সঞ্চয়জাত বা আগ্নেয় পর্বতের উদাহরণ
ইতালির ভিসুভিয়াস, জাপানের ফুজিয়ামা, আফ্রিকার কিলিমানজারো, হাওয়াই
দীপের মনালোয়া প্রভৃতি।
৪. ক্ষয়জাত পর্বত
ভূত্বক গঠনকারী শিলারাশি অসমসত্ত্ব বিভিন্ন প্রকার শিলা দ্বারা গঠিত।
এদের মধ্যে কোনোটি খুব শক্ত, কোনোটি মাঝারি এবং কোনোটি কোমল প্রকৃতির।
ভঙ্গিল পর্বত, স্তূপ পর্বত, সঞ্চয়জাত পর্বত অথবা সুউচ্চ মালভূমির কোমল শিলাগুলো বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত
হয়। এসব ক্ষয়িত পদার্থগুলো অপসারণের ফলে উক্ত পর্বতগুলোর উচ্চতা কিছুটা হ্রাস পায় এবং তার কঠিন অংশ উন্মুক্ত হয়। এতে উক্ত
মূল পর্বত বা সুউচ্চ মালভূমির যে অবশিষ্টাংশ
অনেকটা গম্বুজের ন্যায় দণ্ডায়মান থাকে তাকে ক্ষয়জাত পর্বত বলে।
ক্ষয়জাত পর্বতের চিত্র |
ক্ষয়জাত পর্বতের বৈশিষ্ট্য
i. এ জাতীয় পর্বত দীর্ঘ সময়ে গঠিত হয়।ii. কঠিন ও কোমল শিলার সমন্বয়ে ক্ষয়জাত পর্বত গঠিত।
iii. এটি অনেকটা গম্ভুজাকৃতির এবং কম উচ্চতাসম্পন্ন।
iv. এ জাতীয় পর্বতে ক্ষয়চিহ্ন বিদ্যমান।
ক্ষয়জাত পর্বতের উদাহরণ
ভারতের আরাবল্লি, আফ্রিকার কং, উত্তর আমেরিকার অ্যাপালেশিয়ান প্রভৃতি।
৫. ল্যাকোলিথ বা গম্ভুজ পর্বত
ভূগর্ভ অত্যন্ত উত্তপ্ত বলে ম্যাগমা বা গলিত শিলার উপাদানসমূহের
সাথে নানা গ্যাস মিশ্রিত থাকে। গ্যাস ঊর্ধ্বগামী বলে তা উপরের দিকে
ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উপরে ওঠতে না পেরে তা ভূত্বকের নিচে সঞ্চিত হতে থাকে। ম্যাগমা মিশ্রিত
এ গ্যাস দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত হতে হতে কালক্রমে তা জমাটবদ্ধ হয়ে কঠিন আকার ধারণ করে।
এতে ঊর্ধ্বমুখী চাপের দ্বারা শিলাস্তর স্ফীত হয়ে ভূপষ্ঠের অংশবিশেষ গম্বুজের ন্যায় উঁচু হয়ে যায়। এভাবে ম্যাগমা জমাট বেঁধে
এবং স্ফীত হয়ে যে পর্বতের সৃষ্টি হয় তাকে ল্যাকোলিথ পর্বত বা গম্ভুজ পর্বত বলে।
ল্যাকোলিথ বা গম্ভুজ পর্বতের চিত্র |
ল্যাকোলিথ বা গম্ভুজ পর্বতের বৈশিষ্ট্যসমূহ
i. ল্যাকোলিথ পর্বত দেখতে গম্ভুজাকৃতির ।
ii. এ পর্বতে কোনো শৃঙ্গ থাকে না ।
iii. এ পর্বত অল্প স্থানব্যাপী অবস্থান করে।
iv. এ জাতীয় পর্বতের উচ্চতা কম এবং ঢাল সামান্য খাড়া।
ল্যাকোলিথ বা গম্ভুজ পর্বতের উদাহরণ
উত্তর আমেরিকার ব্লাকহিলস, হেনরি প্রভৃতি।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ভূপৃষ্ঠের সব স্থানের
পর্বত একরূপ নয়। এদের আকার, আকৃতি, উচ্চতা, আয়তন, ভূপ্রাকৃতিক
গঠন প্রকৃতি, উৎপত্তির কারণ ও বিন্যাসের দিক দিয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়।
পর্বত বিভিন্ন চূড়াবিশিষ্ট এবং স্থিতিশীল শিলা দ্বারা গিঠত। এটি পরিবেশ ও মানবজীবনকে
যথেষ্ট প্রভাবিত করে এবং ভূপৃষ্ঠে বৈচিত্র্য
আনয়ন করে।
0 মন্তব্যসমূহ