নাইট্রোজেন চক্র কি
প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের চক্র রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদানের মধ্যে নাইট্রোজেন (N2) অন্যতম একটি চক্র। মূলত বায়ুমণ্ডলীয় উৎস থেকে বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে জীবজগতে বা জীবজগৎ থেকে বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেনের চক্রাকার আবর্তনকে নাইট্রোজেন চক্র বলে। জীবদেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন আবশ্যকীয় প্রোটিনের একটি উপাদান। জীবদেহের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডল হতে আসে।
নাইট্রোজেন চক্র কাকে বলে
যে চক্রাকার
পদ্ধতিতে বায়ু থেকে নাইট্রোজেন (N2) মাটিতে, মাটি থেকে জীবদেহে, জীবদেহ থেকে মাটিতে এবং মাটি থেকে পুনরায়
বায়ুতে ফিরে গিয়ে প্রকৃতির নাইট্রোজেনের সাম্য বজায় রাখে, তাকে নাইট্রোজেন
চক্র (Nitrogen cycle) বলে। বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের
মধ্যে নাইট্রোজেনের (N2) পরিমাণ ৭৮.০৮%। এ গ্যাসের প্রধান উৎস হলো পৃথিবী।
নাইট্রোজেন চক্রের গুরুত্ব
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের চক্র রয়েছে। এর মধ্যে জীবজগতের জন্য নাইট্রোজেন চক্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাইট্রোজেন চক্র জীব ও জড়বস্তুর মধ্যে চক্রাকারে আবর্তিত হয়। ফলে জীবদেহে শক্তি উৎপন্ন হয় । উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। তাছাড়া জীবদেহের স্বভাবিক বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন অত্যাবশ্যকীয় প্রোটিনের একটি উপাদানবিশেষ।
নাইট্রোজেন চক্রের প্রক্রিয়া
নাইট্রোজেনের
চক্র নিম্নোক্ত কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে সংঘটিত হয়।
নাইট্রোজেন চক্রের চিত্র |
১. নাইট্রোজেন সংবন্ধন
নাইট্রোজেন (N2) গ্যাসকে অ্যামোনিয়াতে (NH3) রূপান্তরের
প্রক্রিয়াকে নাইট্রোজেন সংবন্ধন বলে। বায়ুমণ্ডলের মুক্ত নাইট্রোজেনকে জীবজগতের জন্য গ্রহণযোগ্য
আকারে আবদ্ধ করা হয়, যার কারণে একে নাইট্রোজেন
সংবন্ধন বলে। নাইট্রোজেন সংবন্ধন দুই প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। যথা,
ক. ভৌত রাসায়নিক
সংবন্ধন প্রক্রিয়া : ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নাইট্রোজেন স্থিতিকরণকে
ভৌত রাসায়নিক নাইট্রোজেন সংবন্ধন বলে। বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন (N2) একটি নিষ্ক্রিয়
গ্যাস বিধায় স্বাভাবিক অবস্থায় এর সাথে বায়ুর অক্সিজেনের (O2) কোনো বিক্রিয়া ঘটে না। কিন্তু বৃষ্টির সময় বজ্রপাত
হলে নাইট্রোজেন (N2) অক্সিজেন (O2) দ্বারা জারিত হয়ে নাইট্রিক অক্সাইড (NO3) উৎপন্ন হয়।
অতঃপর নাইট্রিক অক্সাইড (NO3) পুনরায় বায়ুর অক্সিজেনের (O2)
সাথে বিক্রিয়া করে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2)
এ পরিণত হয়। নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড (NO2) বৃষ্টির পানিতে দ্রবীভূত হয়ে নাইট্রাস এসিড (HNO2) ও নাইট্রিক
এসিড (HNO3) এ পরিণত হয় এবং ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়।
N2 + O2 = NO (বিদ্যুৎ ক্ষরণ এর উপস্থিতে)
NO + O2 = NO2
NO2 + H2O = HNO2 + HNO3
ভৌত রাসায়নিক
প্রক্রিয়ায় সংঘটিত বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন অ্যামোনিয়ায় পরিণত হয়। অ্যামোনিয়া
ক্রমে নাইট্রাইট ও নাইট্রেট লবণে পরিণত হয় যার কিছু অংশ উদ্ভিদ শোষণ করে নেয়।
খ. জীবজ সংবন্ধন
প্রক্রিয়া : কতকগুলো নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল একটি বিশেষ পদ্ধতিতে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেনকে নাইট্রেটে
রূপান্তরিত করে মৃত্তিকায় আবদ্ধ করে, যাকে বায়োলজিক্যাল নাইট্রোজেন সংবন্ধন
বলে। এ প্রজাতির ব্যাকেটেরিয়া হলো অ্যাজোটোব্যাক্টর
(Azotobacter) এবং শৈবাল হলো এনাবিনা (Anabaena) ইত্যাদি। এছাড়াও জীবজ সংবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু শিম জাতীয় উদ্ভিদের
(ছোলা, মটর প্রভৃতি) মূলে এক প্রকার গুটি থাকে,
যাকে অর্বুদ (Nodule) বলে। এসব অর্বুদের মধ্যে রাইজোবিয়াম (Rizobium) নামক এক প্রকার
মিথোজীবী ব্যাকটেরিয়া বাস করে। এরা মৃত্তিকাস্থিত
বায়ুর নাইট্রোজেনকে নাইট্রেট লবণে রূপান্তর করে মৃত্তিকায় আবদ্ধ করে রাখে।
২. নাইট্রেট তৈরি
অ্যামোনিয়া (NH3) মৃত্তিকাস্থিত কিছু ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতার
মাধ্যমে প্রথমে নাইট্রাইট (NO2) এ পরিণত হয়। পরবর্তীতে নাইট্রাইট আবার
নাইট্রেট (NO3) এ পরিণত হয়, যা পরবর্তী পর্যায়ে উদ্ভিদ দ্বারা শোষিত
হয়।
৩. নাইট্রোজেন আত্মীকরণ
সবুজ উদ্ভিদ মাটি থেকে নাইট্রাইট, নাইট্রেট লবণ ও অ্যামোনিয়াস্থ অজৈব নাইট্রোজেন
গ্রহণ করে যা এমাইনো এসিড এবং প্রোটিন গঠন করে। পরবর্তীতে এ উদ্ভিদ হতে গৃহীত খাদ্যের
মাধ্যমে নাইট্রোজেন প্রাণিদেহে প্রবেশ করে।
৪. অ্যামোনিয়া তৈরি
সবুজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যু হলে মৃতদেহের ওপর কতকগুলো অ্যামোনিফাইং ব্যাকটেরিয়া
কাজ করে মাটিতে
অ্যামোনিয়া মুক্ত করে, যাকে অ্যামোনিয়া তৈরি (Ammonification) বলে।
৫. ডিনাইট্রিফিকেশন
মাটি এবং পানিতে অবস্থিত কিছু ব্যাকটেরিয়া কার্যকারিতার মাধ্যমে নাইট্রেট প্রথমে
নাইট্রাইটে এবং পরে নাইট্রোজেনে (N2) রূপান্তরিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়,
যাকে ডিনাইট্রিফিকেশন বলা হয়। একমাত্র ডিনাইট্রিফিকেশনের
মাধ্যমে মাটি ও পানির নাইট্রেট থেকে নাইট্রোজেন (N2) মুক্ত হয়ে পরিবেশের
ভারসাম্য রক্ষা করে।
0 মন্তব্যসমূহ