প্রাকৃতিক ভূগোল কি বা কাকে বলে
প্রাকৃতিক ভূগোল
বা Physical Geography কথাটির অর্থ হচ্ছে 'Physical basic of Geography' অর্থাৎ ভূগোলের বুনিয়াদ
বা প্রধান উপাদান; যা প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক ভূগোল ভূগোলের একটি প্রধান শাখা।
প্রাকৃতিক ভূগোলকে বাদ দিয়ে ভূগোলকে কল্পনাই করা যায়
না। পরিবেশের সেসব বিষয় নিয়ে প্রাকৃতিক ভূগোল প্রাকৃতিক আলোচনা করে; যা জীবজগতের সমস্ত প্রাণীর জীবনের ওপর প্রভাব
বিস্তার করে। প্রাণীজগত ও জীবজগতের পাশাপাশি পৃথিবীর
আশ্মমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল প্রভৃতি সবকিছুই প্রাকৃতিক ভূগোলের বিষয়। ঊনবিংশ
শতাব্দীর শেষ দিকে ভূগোল শাস্ত্রের অগ্রগতির
বিভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়। সব ধারার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে প্রাকৃতিক ভূগোল। কাজেই,
ভূগোল বিষয়ের যে অংশ পাঠ করলে পৃথিবীর জন্ম, ভূপ্রকৃতি
এবং বায়ুমণ্ডল, বারিমণ্ডল প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা যায়, তাকে প্রাকৃতিক ভূগোল (Physical Geography) বলে। ইংরেজিতে
বলা যায়, "Physical Geography is the
study of features of the earth, relation of earth and men, origin of earth,
physiography land form like mountain, hill,
river, ocean etc." এছাড়াও ভূগোলের যে শাখায় পৃথিবীর জন্ম, বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ ও তার গঠন প্রক্রিয়া, বায়ুমণ্ডল
তথা সমুদ্র তলদেশের ভূপ্রকৃতি, সমুদ্র স্রোত, জোয়ার ভাটা প্রভৃতি প্রাকৃতিক অবয়ব সম্বন্ধে এবং জীবজগতের সাথে এদের পারস্পরিক
আন্ত:সম্পর্ক ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করে, তাকে প্রাকৃতিক ভূগোল (Physical Geography) বলে।
প্রাকৃতিক ভূগোলের পরিধি বা বিষয়বস্তু
মানুষের আবাসভূমি
হিসেবে পৃথিবীর যে বর্ণনা তাই ভূগোল। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিবর্তনের বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রাকৃতিক ভূগোলের বিষয়বস্তু
ও পরিধি ব্যাপক। প্রাকৃতিক ভূগোল প্রকৃতি থেকে
পাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। সৌরজগৎ,
পৃথিবীর উৎপত্তি, ভূত্বকের গঠন কাঠামো ও স্তরবিন্যাস, ভূমিরূপ বিজ্ঞান, জলবায়ু বিজ্ঞান,
সমুদ্র বিজ্ঞান, উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রভৃতি প্রাকৃতিক
ভূগোলে আলোচিত হয়। প্রাকৃতিক ভূগোলের আওতা বা পরিধিকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত
করে আলোচনা করা হলো।
১. ভূমিরূপ বিজ্ঞান
ভূমিরূপ বিজ্ঞান প্রাকৃতিক ভূগোলের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ভূমিরূপ বিজ্ঞান প্রধানত
ভূবিদ্যা হতে উৎপত্তি। ভূমিরূপ বিজ্ঞানে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, খনিজের অবস্থান, শিলার
উৎপত্তি, ভূমিরূপ গঠন প্রক্রিয়া, ভূআন্দোলন
এবং এর ফলে সৃষ্ট ভূমি রূপ, নদী, হিমবাহ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এ বিষয়ে
পৃথিবীর জন্ম সম্বন্ধে কান্ট, লাগ্লাস, স্যার
জেমস প্রমুখ বিজ্ঞ ভূতত্ত্ববিদদের মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা করে। সূর্য হতে পৃথিবী সৃষ্টি
হওয়ার পর প্রাকৃতিক যেসব শক্তি
দ্বারা পৃথিবীর পদার্থসমূহ নিজেদের ঘনত্ব অনুসারে তার কেন্দ্র পর্যন্ত স্তরে স্তরে
সজ্জিত হলো, এসব বিষয় নিয়ে
ভূমিরূপ বিজ্ঞান আলোচনা করে। এ বিষয়ে পৃথিবীর ভূমধ্যস্থ ও তার উপরিভাগের যেসব
প্রাকৃতিক শক্তিসমূহ দ্বারা ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থলভাগ
ও জলভাগের সৃষ্টি হয়ে ভূপৃষ্ঠ সর্বদা পরিবর্তিত হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা করে। এমনকি, ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, হিমবাহ ও বায়ু
দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপের যে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় তাও প্রাকৃতিক ভূগোলের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত।
২. জলবায়ু বিজ্ঞান
জলবায়ু বিজ্ঞানও প্রাকৃতিক ভূগোলের আওতাভুক্ত। জলবায়ু বিজ্ঞান, ব্যয়ুস্তর,
বায়ুর উপাদান, বায়ুর প্রকারভেদ, ধর্ম আর্দ্রতা, ঝড়বৃষ্টি প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা
করে। পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলের জলীয়বাষ্প, বায়ুর আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাতের কারণ, বায়ুচাপের তারতম্যের কারণ, ঘূর্ণিঝড়
প্রভৃতি বিষয়সমূহ নিয়ে আলোচনা করে। পৃথিবীর কক্ষপথটি মহাশূন্যে বিস্তৃত। মহাশূন্যে বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্র নিজ নিজ
কক্ষপথে অবস্থান করে বিচরণ করছে। পৃথিবীকে বেন্টন করে মহাশূন্যের মাঝে গ্যাসীয় আবরণ রয়েছে; যাকে বায়ুমণ্ডল বলে।
বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর সর্বশেষ সীমানা। বিজ্ঞানীদের মতে, ভূপৃষ্ঠ হতে প্রায় ১০,০০০ কি. মি. ঊর্ধ্বকাশব্যাপী বায়ুমণ্ডল
বিস্তৃত। বায়ুমণ্ডলে বিভিন্ন গ্যাস বিদ্যমান, যা পৃথিবীর উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।
৩. সমুদ্র বিজ্ঞান
সমুদ্র বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ও পরিধি ব্যাপক; ভূপৃষ্ঠের ক্ষয়সাধন ও পরিবর্তনে বারিমণ্ডল
তথা সমুদ্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ । ভূপৃষ্ঠের বিশাল এলাকাব্যাপী বারিমণ্ডল বিস্তৃত। এ বারিমণ্ডলের
মধ্যে সাগর, মহাসাগর, উপসাগর, হ্রদ, নদী, ডোবা
প্রভৃতি অবস্থিত। এসব বিষয়াদি সমুদ্র বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। সমুদ্র বিজ্ঞানের মাধ্যমে
পৃথিবীর সাগর মহাসাগরের অবস্থান, আয়তন, গভীরতা,
সমুদ্র তলদেশের সম্পদ, সমুদ্র তলদেশের ভূমিরূপ, সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা, উষ্ণতার তারতম্য, সমুদ্রের পানির বৈশিষ্ট্য, সমুদ্র তলানি,
ঘনত্ব, জোয়ারভাটা প্রভৃতি বিষয়াদি জানা যায়। সমুদ্রের বিশাল পানি উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পকারে পরিণত হয়। পরবর্তীতে তা মেঘে রূপান্তরিত
হয়ে বৃষ্টিরূপে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। হিমমণ্ডলে
বৃষ্টিপাতের পরিবর্তে তুষারপাত্র হয়। পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর নিয়ন্ত্রণসহ পৃথিবীর
মানুষের আর্থসামাজিক জীবনের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করে, এসব
সম্পর্কে সমুদ্র বিজ্ঞানের বিস্তারিত আলোচনার করা হয় । প্রাকৃতিক ভূগোল ভূবিজ্ঞানের একটি প্রাচীনতম শাখা। পৃথিবীর
উপরিভাগে যেসব প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপ প্রতিনিয়ত ঘটছে সেসব বিষয়ের বিভিন্ন দিক প্রাকৃতিক ভূগোলে আলোচিত করে। এ
বিষয়ে সৌরজগতে অবস্থিত বিভিন্ন নীহারিকা, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, ধূমকেতু, ছায়পথ, উল্কাপিণ্ড প্রভৃতি বিষয়
নিয়ে আলোচনা করে। সুমেরু হতে কুমেরু পর্যন্ত অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার অবস্থান, পৃথিবীতে দিবারাত্রির হ্রাস-বৃদ্ধি,
ঋতু পরিবর্তন এবং কোনো স্থানের স্থানীয় সময় ও প্রমাণ সময় প্রভৃতি সম্পর্কে প্রাকৃতিক ভূগোল আলোচনা করে।
উপর্যুক্ত আলোচনার
পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, প্রাকৃতিক ভূগোল' ভূগোল বিষয়ের একটি শাখা, যার বিষয়বস্তু ও পরিধি অনেক
ব্যাপক। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিবর্তনে প্রাকৃতিক ভূগোলের বিষয়বস্তু বিভিন্ন পর্বে পরিবর্তিত
হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের বসতি ও
বিস্তার এবং ক্রিয়াকলাপ পরিবেশের ওপর যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে তা প্রাকৃতিক ভূগোলে আলোচিত হয়।
0 মন্তব্যসমূহ