ভোক্তার উদ্বৃত্ত
অধ্যাপক মার্শালের ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ
বিধি থেকে ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটির জন্য। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোন ভোক্তা কোন দ্রব্য ক্রয়ের জন্য যে দাম দিতে
ইচ্ছুক থাকে এবং প্রকৃতপক্ষে যে দাম দেয়, এ দু'য়ের পার্থক্যকে বলা হয় ভোক্তার উদ্বৃত্ত। ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটি
কয়েকটি অনুমিতির উপর প্রতিষ্ঠিত,
- ক. ভোক্তার নিকট অর্থের প্রান্তিক উপযোগ স্থির,
- খ. উপযোগ পরিমাপের মাধ্যম হিসেবে অর্থ কাজ করে,
- গ. বিবেচিত দ্রব্যটির কোন পরিবর্তক বা পরিপূরক থাকে না,
- ঘ. ভোক্তার রুচি, অভ্যাস ও আয় নির্দিষ্ট সময় স্থির।
একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়।
ধরি, কোন ভোক্তা এক একক কমলালেবুর জন্য 5 টাকা
ব্যয় করতে ইচ্ছুক। অর্থাৎ, এক একক কমলালেবুর জন্য সে 5 টাকা ব্যয় করবে কিন্তু বাজারে গিয়ে সে দেখল প্রতি একক
কমলালেবুর বিক্রয় মূল্য 4 টাকা। এক্ষেত্রে প্রতি একক কমলালেবু থেকে ভোক্তার উদ্বৃত্ত হবে (5–4) = 1 টাকার সমপরিমাণ।
ভোক্তার উদ্বৃত্ত বিষয়টিকে নিয়ে একটি সারণির মাধ্যমে দেখানো হল,
দ্রব্যের পরিমাণ |
ব্যক্তিগত চাহিদার দাম |
বাজার দাম |
ভোক্তার উদ্বৃত্ত |
১ম একক কমলা |
৮ টাকা |
৫ টাকা |
৩ টাকা |
২য় একক কমলা |
৭ টাকা |
৫ টাকা |
২ টাকা |
৩য় একক কমলা |
৫ টাকা |
৫ টাকা |
০ টাকা |
মোট ক্রয় = ৩ একক |
মোট উপযোগ = ২০ টাকা |
মোট দাম =১৫ টাকা |
ভোক্তার উদ্বৃত্ত = ৫ টাকা |
উপরিউক্ত তালিকায় দেখা যায় যে, ডোকা ৩ একক কমলার
জন্য সর্বাধিক ২০ টাকার সমান উপযোগ লাভ করে। কিন্তু বাজার দাম
অনুযায়ী ৩ একক কমলার জন্য তাকে মোট দাম দিতে হয় ১৫ টাকা। অতএব, এক্ষেত্রে
ভোক্তার উদ্বৃত্ত (২০-১৫) = ৫টাকা। ভোক্তার
উদ্বৃত্তকে রেখা চিত্রের মাধ্যমেও প্রকাশ করা যায়। নিম্নে চিত্রের মাধ্যমে
ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটি ব্যাখ্যা করা হল।
উপরের চিত্রে, ভূমি অক্ষে দ্রব্যের মোট পরিমাণ এবং
উলম্ব অক্ষে উপযোগ নির্দেশ করা হয়েছে। চিত্রে, DD হচ্ছে চাহিদা বা উপযোগ রেখা। এক্ষেত্রে OR পরিমাণ দ্রব্য ক্রয় করে
ভোক্তার মোট উপযোগ হচ্ছে ORPD ক্ষেত্র।
কিন্তু প্রতি একক দ্রব্য RP দামে ক্রয় করতে OR এর জন্য মোট দাম প্রয়োজন ORPV
ক্ষেত্র। সুতরাং, ভোক্তার উদ্বৃত্ত হচ্ছে (ORPD - ORPV) =
VPD ক্ষেত্র, যা চিত্রে ছায়াবৃত্ত অঞ্চল দ্বারা দেখানো হয়েছে। ব্যক্তিগত চাহিদা দাম স্থির অবস্থায় বাজার দাম কমে গেলে
এ উদ্বৃত্ত বৃদ্ধি পায় এবং বাজার দাম বৃদ্ধি পেলে ভোক্তার উদ্বৃত্ত হ্রাস পায়। চিত্রে, বাজার দাম কমে ST হলে
ক্রয়ের পরিমাণ বেড়ে OS হয় এবং উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় UTD ক্ষেত্রের সমান। সুতরাং, ভোক্তার উদ্বৃত্ত বিশ্লেষণের
ভিত্তি হিসেবে ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধি কাজ করে থাকে। দ্রব্যের ক্রয় বাড়ানোর সঙ্গে প্রান্তিক উপযোগ
কমতে থাকে। এক্ষেত্রে বলা যায়, ভোক্তা দ্রব্যের প্রান্তিক একক পর্যন্ত মোট উপযোগ কত পায় এবং সে একক পর্যন্ত
মোট কত দাম দিতে হয় এ দু'য়ের ব্যবধান থেকে ভোক্তার উদ্বৃত্ত পাওয়া যায়।
সমালোচনা : ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটি বহু ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হলেও
এটি পরিমাপের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এ কারণে ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটি সমালোচনার
সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচনাগুলো নিম্নরূপ,
১. অর্থের প্রান্তিক উপযোগ : অধ্যাপক মার্শাল অর্থের মাধ্যমে ভোক্তার
উদ্বৃত্ত পরিমাপ করতে গিয়ে ধরে নিয়েছেন যে, সব অবস্থায় ক্রেতার নিকট অর্থের প্রান্তিক উপযোগ স্থির
থাকে। কিন্তু বাস্তবে কোন দ্রব্যের বেশি একক ক্রয় করতে থাকলে ক্রেতার কাছে অর্থের প্রান্তিক উপযোগ ক্রমশ বৃদ্ধি
পেতে থাকে। এ অবস্থায় ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
২. ক্ষতিপূরণমূলক চাহিদা রেখা : ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপের ক্ষেত্রে
সাধারণত আয়ের ক্ষতিপূরণমূলক চাহিদা রেখা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আয়ের ক্ষতিপূরণমূলক চাহিদা রেখা
অঙ্কনের সময় ভোক্তার নিরপেক্ষ মানচিত্র সম্পর্কিত তথ্য প্রয়োজন যা বাস্তবে পাওয়া কঠিন। কাজেই সাধারণ দ্রব্যের
ক্ষেত্রে এরূপ পরিমাপ ভোক্তার উদ্বৃত্তের অতিরিক্ত পরিমাপ নির্দেশ করে।
৩. উপযোগের পরিমাপ : ভোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে পরবর্তী এককগুলোর উপযোগ
ক্রমান্বয়ে কমে যায় বলে ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটিতে অনুমান
করা হয়। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে উপযোগ পরিমাপ করা যায় না। কেননা, উপযোগ হচ্ছে
একটি মানসিক অনুভূতির ব্যাপার।
৪. কাল্পনিক চাহিদা দাম : অধ্যাপক নিকসন ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটিকে
কাল্পনিক ও অবাস্তব বলে অভিহিত করেছেন। কেননা,
পূর্বের এককগুলোর জন্য ক্রেতা কি পরিমাণ দাম দিতে ইচ্ছুক তা জানার উপায় নেই। তাই কাল্পনিক
চাহিদা দামের ভিত্তিতে ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা
বাস্তবসম্মত নয়।
৫. অভ্যাস ও রুচির পার্থক্য : বাজারে বিভিন্ন ব্যক্তির অভ্যাস, পছন্দ,
রুচি বিভিন্ন রকমের হয়। একটি দ্রব্য ভোগ করে এক একজন ভোক্তা বিভিন্ন রকমের উপযোগ লাভ করে। তাই বিভিন্ন
ব্যক্তির ভোগ উদ্বৃত্ত যোগ করে সমষ্টিগত ভোগ উদ্বৃত্ত বের করতে অসুবিধা দেখা যায়।
৬. বিলাসজাত দ্রব্য : অধ্যাপক টাউজিগ বলেছেন, অতি বিলাস ও আড়ম্বরপূর্ণ
দ্রব্য; যেমন- স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র
শৌখিন কোন দ্রব্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত চাহিদা অসীম হয়ে থাকে বলে ভোগ উদ্বৃত্ত
পরিমাপ করা সম্ভব হয় না।
৭. পরিপূরক ও পরিবর্তক দ্রব্য : যেসব দ্রব্যের পরিপূরক ও পরিবর্তক
দ্রব্য আছে তাদের ভোগ নিজস্ব দাম ছাড়াও তাদের পরিপূরক ও পরিবর্তক দ্রব্যগুলোর দামের উপর নির্ভরশীল।
এসব ক্ষেত্রে ভোগ উদ্বৃত্ত পরিমাপ করতে অসুবিধা দেখা দেয়।
৮. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য : নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব
দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকলে ক্রেতা যে কোন দামে ঐ সকল দ্রব্য কিনতে রাজি থাকতে পারে। তাই এসব দ্রব্যের ক্ষেত্রে
ভোক্তার উদ্বৃত্ত পরিমাপ করা যায় না।
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, ভোক্তার উদ্বৃত্ত ভোক্তার
জন্য লাভজনক হলেও বিক্রেতার জন্য তা লাভজনক নাও হতে পারে। বাস্তবে ভোক্তার উদ্বৃত্ত খুঁজে পাওয়া
যায় না, কারণ বাস্তবে ভোক্তা একটি দ্রব্যের জন্য যত টাকা দিতে প্রস্তুত থাকে তার চেয়ে বেশি দামে তাকে দ্রব্যটি ক্রয়
করতে হয়। তবুও ভোক্তার উদ্বৃত্ত ধারণাটির বহুবিধ গুরুত্ব থাকার কারণে অধ্যাপক রবার্টসন এ সম্পর্কে মন্তব্য করেন। এটা
জ্ঞানের দিক থেকে শ্রদ্ধার যোগ্য এবং ব্যবহারিক ক্রিয়াকলাপের পরিচালক।
0 মন্তব্যসমূহ