দুইশত বছরের শাসনকালে ইংরেজদের চাতুর্যপূর্ণ নীতির মধ্যে অন্যতম ছিল ইসলামি সংস্কৃতি বিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা। মুসলমান পরিচালিত অতীতের কিছু বিদ্রোহ মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছিল। ফলে মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের অত্যাচার যেমন বেড়ে উঠে তেমনি ইংরেজ সৃষ্ট হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার এবং নির্বিচার জুলুম তাদের সামাজিক জীবনে দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি করে। মুসলমানদের এ অবস্থা দেখে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ব্যথিত হন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় আলীগড় আন্দোলন।
আলীগড় আন্দোলন কি
স্যার সৈয়দ আহমদ খান ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মুসলমানদের মর্যাদাসহকারে সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে আন্দোলন করেন তা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। আলীগড় আন্দোলন মূলত অষ্টাদশ শতাব্দী ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় মুসলমানদের রক্ষণশীল মনোভাব, কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাস্কৃতিক দিক দিয়ে হিন্দুসমাজের তুলনায় পশ্চাৎপদতার কারণে তাদেরকে পুনর্জাগরিত করার প্রয়াস চালানো হয়। আলীগড় আন্দোলন হলো মুসলমানদের পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন। স্যার সৈয়দ আহমদ ভারতীয় মুসলমানদের সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা মোকাবিলা করার জন্য এ আন্দোলন করেন। তাঁর এ আন্দোলনই আলীগড়ভিত্তিক সংস্কার আন্দোলন যা ইতিহাসে আলীগড় আন্দোলন নামে খ্যাত। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে ভারতের মুসলমানেরা সে সময় চরম দুর্দিনের মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকে। স্যার সৈয়দ আলী আহমদ তার বাস্তব চিন্তা ও দূরদর্শিতার দ্বারা সামগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বুঝতে পারেন যে ইংরেজ ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনই অধঃপতিত মুসলমানদের উন্নতির একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন বাড়িয়ে দেয়া। এ কারণে আলী আহমদ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথ পরিহার করে ইংরেজদের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। আর এভাবেই আলীগড় আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য
স্যার সৈয়দ আহমদ ব্রিটিশ শাসিত ভারতের মুসলমান
সমাজের সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা ও
অর্থনৈতিক দুর্দশা মোকাবিলা করে নিপতিত মুসলিম সমাজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই
আলীগড় আন্দোলনটি গড়ে তোলেন। নিম্নে
আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। অনগ্রসর পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে পুনরুদ্ধার ও
জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এ আন্দোলনটি পরিচালনা করা হয়। যেমন-
- ১. ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি, অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অধঃপতনের হাত থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত মুসলমানদের রক্ষা করা।
- ২.ব্রিটিশ শাসক এবং মুসলিম শাসিতদের ভিতর একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলা যাতে হিন্দুদের মতো মুসলিমরাও প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে নানারকম সুযোগ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পায়।
- ৩. মুসলিম সমাজে বিরাজমান কুসংস্কার, অজ্ঞতা দূর করে সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করা, যাতে অতীতের মতো বর্তমানেও তারা শক্তিশালী একটি জাতি হিসেবে নিজেদেরকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
- ৪.মুসলমান জাতিদের ভিতর পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
- ৫. সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদেরকে হিন্দুদের সমকক্ষ করে গড়ে তোলা। মূলত মুসলমান সমাজের ভিতর বিরাজমান অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও রক্ষণশীল মনোভাব দূর করে তাদেরকে অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করাই হলো আলীগড় আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য।
আলীগড় আন্দোলনের কার্যাবলি
আলীগড় আন্দোলনকে সফল করার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন । আলীগড় আন্দোলনের ক্ষেত্রে গৃহীত কার্যাবলিগুলো
নিম্নে বর্ণনা করা হলো।
১. বই প্রকাশনা : আন্দোলনের প্রারম্ভে স্যার সৈয়দ আহমদ কতিপয় প্রসিদ্ধ
গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৫৯ সালে তিনি শিল্পবিপ্লবের কারণ ও ঘটনাবলি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে 'আলবান-ই-ভাগাওয়াত
হিন্দ' (উর্দু) শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন।
২. পত্রিকা প্রকাশ : পত্রিকা প্রকাশ করে জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যবস্থা
গ্রহণ করা হয়। ১৮৬৬ সালে বিজ্ঞান সমিতির পক্ষ থেকে “আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেট"নামে একটি সাপ্তাহিক
পত্রিকা বের হয়। ১৮৭০ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজের রীতিনীতি সংস্কারের জন্য 'তাহজিবুল আখলাক' নামে উর্দু ভাষায়
একটি পত্রিকা বের করেন।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন : শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্যার
সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৫ সালে আলীগড়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৭ সালে এটি 'মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল
কলেজে' উন্নীত হয় এবং পরে ১৯২০ সালে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নাম ধারণ করে।
৪. মুসলিম সাহিত্য সমাজ : মুসলমানদের মধ্যে থেকে উন্নত চিন্তাধারার
প্রসার, পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজনীতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কে গোঁড়া মুসলমানদের বিদ্বেষ
দূর করার লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালে মোহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স বা মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠন করা হয়।
৫. দুর্ভিক্ষ নিবারণী সমিতি : স্যার সৈয়দ আলী আহম্মদ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের
সময় দুর্ভিক্ষ নিবারণী সমিতির কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হন। একনিষ্ঠ ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে আলী আহমদ
অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
৬. বিজ্ঞান সমিতি : স্যার সৈয়দ আহমদ ১৯৬৩ সালে গাজীপুরে বিজ্ঞান সমিতি গঠন করেন। পরবর্তীতে এটিকে আলীগড়ে স্থানান্তরিত করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পর্কে আলোচনা, প্রচার, পাশ্চাত্য শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন গ্রন্থ ইংরেজি ও উর্দুতে অনুবাদ করা।
উপর্যুক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে আলীগড় আন্দোলন একটি বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে সারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের দায়িত্ব এবং অধিকার সম্পর্কে সজাগ করেছিল। যা মুসলমানদের অবস্থার ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। অন্যভাবে বলা যায় যে এ আন্দোলন মুসলমানদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য দ্বিজাতি তত্ত্বের যে বীজ বপন করেন ব্রিটিশ শাসকরা তাতে জলসিঞ্চন করে ফলবতী করে তোলে।
0 মন্তব্যসমূহ