সুদ কি
সুদ হল মূলধন ব্যবহারের দাম। মূলধন উৎপাদনশীল বলে এটি ব্যবহারের জন্য এর মালিককে যে দাম দেওয়া হয় তাকে সুদ বলে। অর্থাৎ, মূলধন ব্যবহার করে অতিরিক্ত উৎপাদন পাওয়া যায় বলে সংগঠন (ঋণগ্রহীতা) ঋণদাতার নিকট হতে মূলধন ধার করে উৎপাদন কাজে বিনিয়োগ করে লাভবান হয়। সুতরাং, সংগঠক যখন ধার করা মূলধন ফেরত দেয় তখন সে অতিরিক্ত কিছু অর্থ ঋণদাতাকে প্রদান করে। এই অতিরিক্ত অর্থকেই সুদ বলা হয়। আবার সুদকে অপেক্ষার পারিতোষিকও বলা হয়। কারণ ঋণদাতা যখন টাকা ধার দেয় তখন তাকে বর্তমান ভোগ ত্যাগ করতে হয়। তাছাড়া ধার দেওয়া টাকা ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হয়। এভাবে বর্তমান ভোগ বিসর্জন দিয়ে অপেক্ষা করার জন্য মূলধনের মালিককে যে পারিতোষিক দেওয়া হয় তাই সুদ। কাজেই, ঋণগ্রহীতার দিক হতে সুদ হল মূলধনের উৎপাদন ক্ষমতার পারিতোষিক। আবার ঋণদাতার দিক হতে সুদ হল অপেক্ষার পারিতোষিক। নিম্নে কয়েকজন অর্থনীতিবিদের প্রদত্ত সুদের সংজ্ঞা প্রদান করা হল।অধ্যাপক মার্শালের মতে, 'সুদ হল ভবিষ্যৎ ভোগের প্রতীক্ষার পুরস্কার।‘
লর্ড কেইনসের মতে, ‘একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তরল অর্থ হাতছাড়া
করার পারিতোষিকই সুদ।‘
অধ্যাপক রবার্টসনের মতে, ‘সুদ হল ঋণযোগ তহবিলের ব্যবহারের দাম।‘
অধ্যাপক সিনিয়র এর মতে, ‘সুদ হচ্ছে বর্তমান ভোগ বিরতির পুরস্কার।‘
এভাবে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ সুদের বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন।
এসব সংজ্ঞা হতে সংক্ষেপে বলা যায়, মূলধন ব্যবহারের জন্য ঋণগ্রহীতা একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তে ঋণদাতাকে
যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে থাকে তাকেই সুদ বলা হয়।
সুদ কেন দেওয়া হয়
সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ
হতে সুদের লেনদেন অত্যন্ত গর্হিত কাজ। ইসলাম ধর্মে সুদ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। অন্যান্য অনেক ধর্মেও সুদের
লেনদেনকে নিন্দা করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও বর্তমান যুগে সুদের অবাধ লেনদেন চালু
আছে। সুদের এরূপ লেনদেন হতে এটি সুস্পষ্ট যে, উৎপাদন
বৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমৃদ্ধি লাভের জন্য মূলধন অপরিহার্য। মূলধন লাভের জন্যই মূলত সুদ প্রদান করা হয়।
অবশ্য অর্থনীতিবিদগণ সুদ প্রদানের স্বপক্ষে নানা ধরনের যুক্তি প্রদর্শন করেছেন। নিম্নে সুদ প্রদানের কারণসমূহ
আলোচনা করা হল।
১. মূলধনের উৎপাদনশীলতা :
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণের মতে, মূলধনের উৎপাদনশীলতার জন্য সুদ দেওয়া হয়। মূলধন উৎপাদনশীল। উৎপাদন কাজে মূলধন
ব্যবহার করে অতিরিক্ত উৎপাদন পাওয়া যায়। ফলে ঋণগ্রহীতা লাভবান হয় বলে ঋণদাতাকে কিছু অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে
হয়। সুতরাং, মূলধনের উৎপাদনশীলতার জন্য সুদ প্রদান করা হয়।
২. ভোগ বিরতির পারিতোষিক :
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ যোগানের দিক হতে সুদের কারণ ভোগ বিরতি তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। মূলধনের যোগান
সঞ্চয়ের উপর নির্ভর করে। সঞ্চয়ের জন্য ঋণদাতাকে আবার ভোগ হতে বিরত থাকতে হয়। কিন্তু বর্তমান ভোগ পরিহার করা বেশ কষ্টকর ও
বেদনাদায়ক। এমতাবস্থায়; সঞ্চয়ে আকৃষ্ট করার জন্য ঋণদাতাকে পুরস্কার দেওয়া দরকার এজন্য ভোগ বিরতির
পুরস্কার স্বরূপ সুদ দেওয়া হয়।
৩. বর্তমান ভোগ বিসর্জন :
অধ্যাপক ফিশার সময় পছন্দ তত্ত্ব দ্বারা সুদের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। ফিশারের মতে, মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাই মানুষ
বর্তমান ভোগকে বেশি পছন্দ করে। বর্তমান ভোগের প্রতি মানুষের পছন্দ হতে নিবৃত্ত করে তাকে সঞ্চয় ও ঋণদানে প্রবৃত্ত করাতে
হলে কিছু পুরস্কার দেওয়া প্রয়োজন। সুতরাং, বর্তমান ভোগ বিসর্জনের পারিতোষিক হিসেবে সুদ দেওয়া হয়।
৪. অপেক্ষার পারিতোষিক :
অধ্যাপক মার্শালের মতে, সুদ হল অপেক্ষার পারিতোষিক। মূলধন ধার দেওয়ার পর তা ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত ঋণদাতাকে
অপেক্ষা করতে হয়। এ টাকায় মুনাফা অর্জনের কোন লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ পেলেও তার পক্ষে সেই সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়
না। এমতাবস্থায় মূলধন ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য ঋণদাতাকে মূলধনের উপর কিছু সুদ প্রদান করা
হয়।
৫. নগদ অর্থ ত্যাগের পুরস্কার : লর্ড কেইনস নগদ পছন্দ তত্ত্বের সাহায্যে সুদ প্রদানের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, সুদ হল মানুষের নগদ পছন্দ পরিত্যাগের পুরস্কার। কেননা নগদ অর্থ মানুষকে দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখে এবং এর দ্বারা সে বিপদ আপদের মোকাবেলা করতে পারে। তাছাড়া নগদ অর্থ হাতে থাকলে মানুষ যে কোন সময় যে কোন প্রয়োজন মেটাতে পারে। কিন্তু ঋণ দিতে হলে এ নগদ পছন্দ ত্যাগ করতে হয়। এমতাবস্থায় নগদ অর্থ হাত ছাড়া করার পারিতোষিক হিসেবে সুদ প্রদান করা হয়।
৬. মূলধনের দুষ্প্রাপ্যতা : মূলধন উৎপাদনশীল বলে উৎপাদন
কাজের জন্য মূলধনের চাহিদার সৃষ্টি হয়। কিন্তু চাহিদার তুলনায় মূলধনের যোগান সীমাবদ্ধ। তাই পারিতোষিক বা সুদ
ছাড়া উৎপাদন কাজে মূলধন পাওয়া যায় না। সুতরাং, মূলধনের চাহিদার তুলনায় যোগান কম হওয়ার কারণে সুদ প্রদান করতে
হয়।
সুতরাং, উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, মূলধনের চাহিদা ও
যোগান ব্যাখ্যা করলে জানা যায় সুদ কেন দেওয়া হয়।
0 মন্তব্যসমূহ