প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব আলোচনা কর

 

প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব আলোচনা কর

প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব

প্রাণিবিজ্ঞান মানব সভ্যতা বিকাশে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ ইত্যাদি মৌলিক চাহিদাগুলির সাথে মানব জাতি প্রাণীর উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রাণিবিজ্ঞানের পরিধি ও ব্যবহারিক প্রয়োগ বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিম্নে প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব বর্ণিত হল।

মানব কল্যাণে প্রাণিবিজ্ঞানের গুরুত্ব

(Importance of Zoology for the welfare of human beings)

১. প্রাণী সনাক্তকরণ ও শ্রেণিবদ্ধকরণ (Animal identification and classification) : বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন এ পৃথিবীতে প্রায় এক-কোটি প্রাণী প্রজাতি থাকতে পারে। অদ্যাবধি প্রায় ১৫ লক্ষের অধিক প্রাণী সনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন প্রাণী আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং সনাক্তকরণ, নামকরণ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য প্রাণিবিজ্ঞান অধ্যয়ন অপরিহার্য।

২. মানবজাতি ও প্রাণিজগৎ সম্পর্কে ধারণা (Idea about mankind and animal kingdom) : মানুষ ও প্রাণিজগতের অন্যান্য সদস্যদের উৎপত্তি, অবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় প্রাণিবিজ্ঞান পাঠে জানা যায়।

৩.কৃষি উন্নয়ন (Agricultural development) : ফলিত প্রাণিবিজ্ঞানের কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন শাখা যেমন- রেশম চাষ, লাক্ষা চাষ, মৌমাছি চাষ, মুক্তা চাষ, পোল্ট্রি ফার্মে মাৎস্য চাষ, ডেইরী ফার্মিং ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে জানতে ও ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে প্রাণিবিজ্ঞান পর্বের গুরুত্ব অপরিসীম।

৪. জৈবপ্রযুক্তি প্রয়োগ (Application of biotechnology) : প্রাণিবিজ্ঞান পাঠে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে জৈব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে যেমন সুবিধা পাওয়া যায় তেমন এর বাস্তবে সঠিক প্রয়োগ করা যায়।

৫. চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন (Development of medical science) : প্রাণিবিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞান পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বিভিন্ন প্রকার পরজীবী মানব দেহে কঠিন রোগ সৃষ্টি করে। অনেক প্রাণী পরজীবির মানব দেহে কঠিন রোগ সৃষ্টি করে। অনেক প্রাণী পরজীবী বাহক। প্রাণিবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে এদের জীবন বৃত্তান্ত জানা গেলে এদের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

৬. ঔষধ শিল্প (Pharmaceuticals): অনেক প্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গ, গ্রন্থি ব্যবহার করে এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জ্ঞান প্রয়োগ করে অনেক প্রাণী থেকে ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। এসব জ্ঞান প্রাণিবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব।

৭. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (Wildlife conservation) : মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রাণিবিজ্ঞান অধ্যয়নে প্রাপ্ত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বন্যপ্রাণী থেকে প্রাপ্ত হাড়, মাংস, চামড়া, রক্তবাহিকা বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে।

৮. খাদ্য উৎপাদন (Food production): প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদনে প্রাণিবিজ্ঞানের ভূমিকা রয়েছে। মানুষ-প্রাণিবিজ্ঞান পাঠে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নতমানের পশুখাদ্য উৎপাদন করে প্রাণীর প্রোটিন খাদ্যের চাহিদা মিটায়।

৯. কীটপতঙ্গ দমন (Past control): কীটপতঙ্গসহ অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী ফসলসহ গুদামজাত শস্যের, প্রচুর ক্ষতি সাধন করে। প্রাণিবিজ্ঞান পাঠে প্রাপ্ত জ্ঞান এসব ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমনে সহায়তা করে।

১০. খনিজ সম্পদ সন্ধান (Survey of mineral resources) : মাটির নিচে প্রাপ্ত জীবাশ্ম (fossil) থেকে বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া ভূস্তরের বিভিন্ন অংশে সঞ্চিত প্রাণী জীবাশ্ম পরীক্ষা করে ভূস্তর ও জীবাশ্মের বয়স নির্ধারণ করা যায়।

১১. চিত্তবিনোদন (Recreation) : মানুষ অবসর সময় কাটানোর জন্য ও মানসিক সন্তুষ্টির জন্য চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক, একোরিয়ামে পালিত মৎস্য পরিদর্শন করে। এসব চিত্তবিনোদনের সাথে জড়িত প্রাণী নির্বাচনে, সংরক্ষণ ও প্রতিপালনে প্রাণিবিজ্ঞান পাঠ করা প্রয়োজন হয়।

১২. বৈজ্ঞানিক গবেষণা (Scientific research) : বিভিন্ন ঔষধ, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহারের পূর্বে প্রাণীর উপকারী ও অপকারী ভূমিকা জানার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে হয়। এসব কাজে প্রাণিবিজ্ঞান অধ্যয়ন প্রয়োজন হয়।

১৩. গৃহপালিত পশুপাখি (Domestic animals & birds) : মানুষ তাদের নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের পশু পাখিকে গৃহে লালনপালন করে। এদের মধ্যে গরু, মহিষ, কৃষি কাজে, দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। কুকুর, গৃহ পাহারার কাজে, বিড়াল, টিয়া, ময়না ইত্যাদি প্রাণী সৌখিনতার প্রতীক হিসেবে বিনোদনের জন্য পালা হয়। এসব প্রাণী নির্বাচন, প্রতিপালন ইত্যাদির জন্য প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব রয়েছে।

পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণিবিজ্ঞানের গুরুত্ব

(Importance of the study of Zoology for maintaining environmental balance)

অজীব ও জীবের আন্তঃক্রিয়ার ফলে পরিবেশের স্থিতি অবস্থা বিরাজ করে। এ স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য পরিবেশীয় উপাদানগুলি বিভিন্ন চক্রে আবর্তিত হয়। চক্রায়ন বন্ধ হলে পরিবেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় ও ভারসাম্যপূর্ণ ও স্বাস্থ্যসম্মত প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হয়। ফলে পরিবেশে বসবাসকারী সকল জীব সদস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের অর্জিত জ্ঞান নিম্নোক্তভাবে সাহায্য করে।

১. বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য (Balance of ecosystem) : কোন নির্দিষ্ট বাস্তুতন্ত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঐ বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন খাদ্য স্তরের (tropical level) সদস্যরা অভিযোজিত হয়। প্রাকৃতিক বা মানুষ্য সৃষ্ট কোন কারণে কোন বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশের পরিবর্তন ঘটলে সেই বাস্তুতন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট জীবদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। বাদ্যচক্রের শক্তি প্রবাহে বিঘ্নতা সৃষ্টির মাধ্যমে উক্ত বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। ফলশ্রুতিতে মানবজাতির জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।

২. শক্তি প্রবাহ (Energy flow): পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোন স্থানের বাস্তুতন্ত্রের শক্তির প্রবাহ অক্ষুণ্ণ থাকা প্রয়োজন । শক্তির প্রধান উৎস সূর্য এবং এই সৌরশক্তি ক্লোরোফিল বহনকারী উৎপাদক ধারণ করে যা পর্যায়ক্রমে ১ম স্তরের খাদক গ্রহণ করে। ২য় স্তরের খাদক কোন কোন ক্ষেত্রে ৩য় স্তরের খাদকের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। অতঃপর বিয়োজকের মাধ্যমে বিয়োজিত হয়ে পরিবেশে মুক্ত হয়।

৩. গ্যাসীয় উপাদান নিয়ন্ত্রণ (Control of gaseous components) : জীব তথা বিভিন্ন প্রাণী পরিবেশের গ্যাসীয় উপাদানের ভারসাম্য রক্ষা করছে। উদ্ভিদ যেমন CO2) গ্রহণ করে তেমনি প্রাণীকুল O2 গ্রহণ করে CO2 ত্যাগ করে ফলে পরিবেশে গ্যাসীয় ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে।

৪. জীবজ নিয়ন্ত্রণ (Biological control) : ক্ষতিকর পতঙ্গ ও অন্যান্য প্রাণীর প্রভাব থেকে বিভিন্ন প্রাণীকুলকে তথা জীবকে অনেক উপকারী পরজীবী ও শিকারী প্রাণী রক্ষা করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- ব্যাঙ, মাকড়সা প্রচুর ক্ষতিকর পতঙ্গ ভক্ষণ করে জীবজ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

৫. মাটির উর্বরতা (Fertility of the soil) : কেঁচো, গোবরের পোকা ও মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন ধরনের প্রাণী উপরের মাটি নিচে ও নিচের মাটি উপরে এনে মাটিতে বায়ু ও পানি প্রবেশে সহজতর করে ও পাশাপাশি তাদের বিষ্ঠা ও মৃতদেহের পচনশীল অবশিষ্টাংশ দ্বারা উর্বর করে ফসল ফলনে সহায়তা করে। ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।

৬. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (Wildlife conservation) : মানব সভ্যতার উন্নয়নের ফলে বন্যপ্রাণী ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। বন্যপ্রাণী খাদ্য শৃঙ্খলের সাথে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। তাই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মাধ্যমে অবিচ্ছিন্ন খাদ্য শৃঙ্খল-এর নিশ্চয়তা বিধান করা দরকার, যা মানুষের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৭. পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ (Control of environmental pollution) : বিভিন্ন প্রাণী বা জীবের মৃতদেহ পচে গলে পরিবেশ দূষিত করে। এক্ষেত্রে ছুঁচো, কাক ও অন্যান্য ময়লা খাদক পাখি, মাছির লার্ভা ইত্যাদি আবর্জনা অপসারণ করে পরিবেশ নির্মল রাখে। তেজস্ক্রিয় পদার্থ, রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারে জীবিত প্রাণী তথা সকল জীবের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। প্রাণিবিজ্ঞান পঠিত জ্ঞান দ্বারা এসব সমস্যা সমাধান করে স্বচ্ছ ও নির্মল পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ