কোষ কি
কোষের প্রোটোপ্লাজম অর্ধভেদ্যপর্দা দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। আত্ম প্রজননে সক্ষম কোষ জৈবনিক কার্যকলাপ ও দেহ গঠন করে। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে A.G. Loewy এবং P. Seikevitz কোষের সর্বজন সমর্থিত সর্বাধুনিক সংজ্ঞা প্রদান করেন। "Cell is a unit of biological activities delimited by a semipermeable membrane and capable of self-reproduction in a medium free of other living systems." অর্থাৎ অর্ধভেদ্য পর্দাবেষ্টিত জৈবনিক ক্রিয়াকলাপের একক যা কোন সজীব মাধ্যম ব্যতীত স্বপ্রজননে সক্ষম, তাকে কোষ বলে। কোষকে নিম্নোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়।
অর্ধভেদ্য আবরণী বেষ্টিত সজীব প্রোটোপ্লাজম দ্বারা গঠিত জীবদেহের যে স্বনির্ভর একক অংশ জীবনের ভৌত সত্তার মৌলিক একক হিসেবে অনুকূল পরিবেশে স্বপ্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রকরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম তাকে কোষ বলে। উদাহরণ – স্নায়ু কোষ, যকৃত কোষ, পেশী কোষ ইত্যাদি।
কোষবিদ্যা (Cytology) : জীববিজ্ঞানের যে শাখায় কোষের আঙ্গিক, ভৌত, রাসায়নিক গঠন, জৈবিক কার্যাদি, বৃদ্ধি, বিভাজন ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয় তাকে কোষবিদ্যা বলা হয়।
কোষের উৎপত্তি
কোষ সম্পর্কিত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সপ্তদশ শতাব্দী
থেকে শুরু হয়। ব্রিটিশ প্রকৌশলী রবার্ট হুক ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে
বোতলের ছিপির পাতলা প্রস্থচ্ছেদ নিজের তৈরি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পর্যবেক্ষণ করে
মৌচাকের কুঠুরীর মত অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ
দেখেন এবং এগুলিকে কোষ (Cell) নামে অভিহিত করেন। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে লিউয়েন হুক সজীব কোষে তরল বস্তুর উপস্থিতি
লক্ষ্য করেন। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ফন্টানা সর্বপ্রথম কোষে কোষে
নিউক্লিয়াসের অস্তিত্ব সম্পর্কে মত প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে
স্কটল্যান্ডবাসী বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রাউন ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে অবস্থিত ঘন গোলাকার অসমসত্ত্ব বস্তুর নিউক্লিয়াস নাম দেন
ও এর গঠন বর্ণনা করেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ডুজারডিন বর্ণিত কোষের জেলীর ন্যায় পদার্থকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে পারকিনজি
প্রোটোপ্লাজম নামে আখ্যায়িত করেন।
কোষ মতবাদ (Cell theory)
বিখ্যাত জার্মান প্রাণীবিজ্ঞানী থিওডোর শোয়ান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী
এম জে স্লাইডেন ১৮৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে কোষ সম্পর্কে যুগান্তকারী কোষ মতবাদ প্রকাশ করেন। তাদের এই সরল মৌলিক ও
নিয়মানুগ জীবতাত্ত্বিক বিবৃতিকে কোষ মতবাদ বলে। পরবর্তী সময় এই মতবাদের কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জন হয়। Schwan উদ্ভিদ
ও প্রাণীকলার উপর গবেষণা করে কোষের বিপাকীয়
কার্যাবলি প্রত্যক্ষ করেন এবং বলেন সকল জীবই কোষ ও কোষ উৎপাদিত বস্তু দ্বারা গঠিত হয়।
K. Nageli (1846) প্রমাণ করেন যে, উদ্ভিদের
কোষগুলি পূর্বে বিদ্যমান কোষের বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হয়। এছাড়া R. Virchoa (1835) মতামত ব্যক্ত করেন যে, নতুন কোষ কেবল পূর্বতন
কোষের বিভাজনে উৎপন্ন হয়। কোষ মতবাদের খ্যাতি মূলত শ্বোয়ান ও স্লাইডেন-এর প্রাপ্য হলেও আসলে এ মতবাদ অসংখ্য গবেষকের
গবেষণার ফল। যার গোড়াপত্তন হয়েছিল
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই। সকল বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতবাদসমূহ বিশ্লেষণ করে বর্তমানে
যে আধুনিক কোষ মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়
তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল।
- ১. সকল জীবদেহ কোষ ও কোষ উদ্ভূত বস্তু দ্বারা গঠিত হয়। অর্থাৎ কোষ হচ্ছে জীবদেহের গাঠনিক একক।
- ২. কোষ হচ্ছে জীবের সব ধরনের ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ কোষ জীবদেহের কার্ষিক একক।
- ৩. জীবদেহের সকল কোষই পূর্বে বিদ্যমান কোষ থেকে সৃষ্টি হয় অর্থাৎ কোষ কখনই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয় না।
- ৪. বংশগতির মূল কণিকা জিন। এই জিনের বাহক কোষ সুতরাং প্রকারান্তরে কোষ বংশগতির বাহকও বটে।
- ৫. বহুকোষীয় জীবদেহের সকল জৈবনিক ক্রিয়াকলাপ দেহস্থ কোষসমূহের আন্তঃক্রিয়াকলাপের সমষ্টি।
কোষতত্ত্বের সীমাবদ্ধতা (Limitation of cell theory)
- ১. কোষতত্ত্বের ন্যায় অতি ব্যাপক তত্ত্বে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। বিশেষ করে ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর কোষীয় বিভিন্ন অঙ্গাণুর গঠন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করায় কোষতত্ত্বের কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সকল জীব যদি আবহমান কাল থেকে একমাত্র কোষ দ্বারাই গঠিত হয়ে থাকত, যদি কোষ হতেই কোষের উৎপত্তি হয়ে থাকত এবং জীব হতেই জীবের উৎপত্তি সত্য হয়ে থাকত তবে বলতে হয় যে পৃথিবীতে সর্বদা জীব তথা জীবনের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু এই তত্ত্ব সঠিক নয়। পৃথিবীর বয়স প্রায় পাঁচ কোটি বছর । শুরু হতে ১.২ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে জীবের কোন অস্তিত্ব ছিল না। এর অর্থ এই যে পৃথিবীতে সর্বদা কোষ তথা জীবের অস্তিত্ব ছিল না। বিবর্তনবাদ অনুসারে মনে করা হয় যে, এই পৃথিবীতে এক সময় প্রাণহীন জড় বস্তু থেকে জীব তথা কোষের উদ্ভব হয়েছিল অর্থাৎ প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল।
- ২. কোষতত্ত্ব মতে আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, সমস্ত
জীবদেহই কোষ দ্বারা গঠিত। বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতার যুগে দেখা যায় এমন অনেক জীব রয়েছে যারা অকোষীয়। উদাহরণস্বরূপ
ভাইরাসের কথা উল্লেখ করা যায়। ভাইরাসের কোষীয় অনেক বৈশিষ্ট্য না থাকা সত্ত্বেও এরা জীব সম্প্রদায়ভুক্ত। কারণ- ভাইরাসের
দেহে সুনির্দিষ্ট জেনেটিক বস্তু রয়েছে, এরা আত্মপ্রজননে
সক্ষম। এদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক ক্রিয়া সংঘটিত হয়। এরা কঠিন খাদ্য
গ্রহণেও সক্ষম। সুতরাং ভাইরাস অকোষীয় জীব।
তাই ভাইরাসের ক্ষেত্রে কোষ মতবাদ বা তত্ত্ব কার্যকরী হচ্ছে না।
- ৩. কোষতত্ত্ব মতে পূর্বে সৃষ্ট কোষ হতে অন্য কোষের
সৃষ্টি হয়। তাহলে আদিতম কোন জীবের প্রথম উৎপত্তি সম্পর্কে কোষ মতবাদ কোন ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়।
- ৪. কোষতত্ত্ব মতে সকল কোষেই সুস্পষ্ট নিউক্লিয়াস
থাকে। কিন্তু কিছু জীব রয়েছে যাদের সুস্পষ্ট কোন নিউক্লিয়াস নেই। যেমন- ভাইরাস। এদের সুস্পষ্ট নিউক্লিয়াস নেই কিন্তু
এদের গাঠনিক উপাদানের মধ্যে প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড রয়েছে।
- ৫. কোষতত্ত্ব মতে আবরণী বেষ্টিত প্রোটোপ্লাজম ও
নিউক্লিয়াস সমন্বিত বস্তুকণাই হচ্ছে কোষ। বাস্তবে এমন কিছু আণুবীক্ষণিক জীব রয়েছে যাদের নিউক্লিয় বস্তুর বাইরে
নিউক্লিয়ার পর্দা থাকে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- কিছু কিছু সবুজ শেওলা ও ভাইরাসে উল্লিখিত অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।
- ৬. এছাড়া কিছু কিছু জীবের দেহে একাধিক নিউক্লিয়াস থাকলেও কোন কোষীয় একক থাকে না। এদের ক্ষেত্রেও কোষ মতবাদ প্রযুক্ত হয় না। যেমন- Vaucheria, Rhizopus ও কিছু কিছু Paramecium জাতীয় প্রোটোজোয়ায় এ অবস্থা দেখা যায় ।
0 মন্তব্যসমূহ