ক্রোমোজোম কি এবং কাকে বলে
কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত সুতার মত যে গঠনগুলি বংশগতির
মূল কণিকা বা জিন (gene) বহন করে এবং মিউটেশন,
প্রকরণ ও বিবর্তনীয় গতিধারায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে তাদেরকে ক্রোমোজোম বলে।
অন্যভাবে বলা যায়, নিউক্লিয়াসে অবস্থিত নিউক্লিওপ্রোটিনে
নির্মিত যেসব তন্ত্রর মাধ্যমে জীবের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয় তাকে ক্রোমোজোম বলে।
আবিষ্কার (Discovery)
Nagoli ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে উদ্ভিদকোষে সর্বপ্রথম ক্রোমোজোম প্রত্যক্ষ করেন। অতঃপর Waldeyer ১৮৮৮
খ্রিস্টাব্দে রঞ্জন ধারণক্ষমতার জন্য এসব বস্তুকে ক্রোমোজোম
নামকরণ করেন। পরবর্তীতে Boveri (১৯০২) ক্রোমোজোমকে
বংশগতি বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসেবে বর্ণনা দেন।
ক্রোমোজোমের সংখ্যা (Number of chromosome)
দেহকোষের ক্রোমোজোম সংখ্যাকে ডিপ্লয়েড
সেট (2n) বলে। পক্ষান্তরে জনন কোষের ক্রোমোজোম
সংখ্যা নির্দিষ্ট প্রজাতিতে নির্দিষ্ট থাকে।
কয়েকটি প্রাণীর (2n) ডিপ্লয়েড সেট ক্রোমোজোম সংখ্যা
: ড্রসোফিলা- ৪, গৃহমাছি- ১২, মৌমাছি- ৩২, মানুষ-
৪৬, মুরগি-৭৮, কবুতর-৮০।
আয়তন (Size)
সাধারণ ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্যে ০.২৫-৫০ μm এবং ব্যাস ০.০২-২μm হতে পারে। মানুষের ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য ৬μm।
ক্রোমোজোমের ভৌত গঠন (Physical structure of chromosome)
কোষ বিভাজনের মেটাফেজ দশায় ক্রোমোজোমগুলি বিশেষভাবে সুগঠিত হয় এবং ভালোভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এসময় দৃষ্ট একটি আদর্শ ক্রোমোজোমের বিভিন্ন অংশের বর্ণনা নিম্নে দেওয়া হলো।
ক্রোমোজোমের ভৌত গঠন |
১. ক্রোমাটিড (Chromatid) : মেটাফেজ দশায় প্রতিটি ক্রোমোজোম
লম্বালম্বিভাবে দুটো সুতার মত অংশ নিয়ে গঠিত হয়। এদের প্রত্যেকটিকে ক্রোমোটিড বলে।
২. ক্রোমোনেমা (Chromonema) : প্রতিটি ক্রোমাটিড লম্বালম্বিভাবে
একাধিক তন্ত্র নিয়ে গঠিত হয়। এসব তন্ত্রকে ক্রোমোনেমা
বলে। এসব ক্রোমোনেমা পরস্পরকে পেঁচিয়ে অবস্থান করে। ক্রোমোনেমার সংখ্যাও এ প্রজাতিভেদে
দুই, চার বা ততোধিক হতে পারে।
নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজোমের বিভিন্ন অংশ |
৩. ক্রোমোমিয়ার (Chromomere) : প্রতিটি ক্রোমাটিডের
দৈর্ঘ্য বরাবর পুঁতির দানার মত কতকগুলি বস্তু থাকে এদেরকে ক্রোমামিয়ার বলে । এগুলি প্রফেজের লেপ্টোটিন উপদশায় ভালভাবে
দৃষ্টিগোচর হয়। বিজ্ঞানীদের মতে DNA অণু কুণ্ডলিত হয়ে এসব ক্রোমোমিয়ার গঠন করে।
৪. সেন্ট্রোমিয়ার (Centromere) : মাইটোটিক মেটাফেজ
দশায় প্রতিটি ক্রোমোজোম যে গোলাকার, বর্ণহীন
ও সংকুচিত স্থান
দেখা যায় তাকে সেন্ট্রোমিয়ার বলে। একটি ক্রোমোজোমের সাধারণত একটি সেন্ট্রোমিয়ার
থাকে। এক সেন্ট্রোমিয়ার বিশিষ্ট ক্রোমোজোমকে মনোসেন্ট্রিক, দুই সেন্ট্রোমিয়ার বিশিষ্ট
ক্রোমোজোম ডাইসেন্ট্রিক ও দুই এর অধিক সেন্ট্রোমিয়ার বিশিষ্ট ক্রোমোজোমকে পলিসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম বলে।
ক্রোমোজোমের প্রকারভেদ
সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ক্রোমোজোমের প্রকারভেদ নিম্নে বর্ণিত হল।
১. অ্যাক্রোসেন্ট্রিক (Acrocentric) : সেন্ট্রোমিয়ার
যে ক্রোমোজোমের প্রান্তের কাছাকাছি অবস্থান করে, তাকে অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম বলে। অ্যানাফেজ দশায় এ ধরনের
ক্রোমোজোমকে J আকৃতির মত দেখায়। মানুষের মধ্যে অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম দেখা যায়।
২. সাব-মেটাসেন্ট্রিক (Sub-metacentric) : সেন্ট্রোমিয়ার
যে ক্রোমোজোমের মধ্যস্থলের কাছাকাছি অবস্থান করে তাকে সাব-মেটাসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম বলে। অ্যানাফেজ দশায় এ ধরনের
ক্রোমোজোমকে আলফা (α) অক্ষরের মত দেখায়। এ ধরনের ক্রোমোজোম মানুষের মধ্যে দেখা যায়।
৩. মেটাসেন্ট্রিক (Metacentric) : সেন্ট্রোমিয়ার
যে ক্রোমোজোমের ঠিক মধ্যস্থানে অবস্থান করে তাকে মেটাসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম বলে। অ্যানাফোজ দশায় এ ক্রোমোজোম V অক্ষরের মত
দেখায়। এ ধরনে ক্রোমোজোম মানুষে পরিলক্ষিত হয়।
৪. টেলোসেন্ট্রিক (Telocentric) : সেন্ট্রোমিয়ার যে ক্রোমোজোমের কোন এক প্রান্তে অবস্থান করে তাকে টেলোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম বলে। এ সব ক্রোমোজোম অ্যানাফেজীয় বিচলনের সময় ইংরেজি অক্ষরের মত দেখায়। এ ধরনের ক্রোমোজোম প্রোটোজোয়াতে দেখা যায়।
সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকার ক্রোমোজোম |
বাহু (Arm) : সেন্ট্রোমিয়ারের উভয় দিকে প্রসারিত
ক্রোমোজোমের অংশগুলিকে বাহু বলে। দুটো বাহু কখনও সমান বা কখনও অসমান হয়।
পেলিকল (Pellicle) : আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ক্রোমোজোমকে ঘিরে যে পর্দা দেখা যায় তাকে পেলিকল বলে। ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পেলিকলের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।
ধাত্র (Matrix) : বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল পেলিকল আবৃত অবস্থায় ধাত্র বস্তুর মধ্যে ক্রোমোনেমা থাকে কিন্তু ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধাত্রের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না।
টেলিমোর (Telemore) : ক্রোমোজোমের বিশেষ গুণসম্পন্ন শীর্ষ প্রান্ত দুটো যা অন্য ক্রোমোজোম বা ক্রোমোজোমের ভগ্ন অংশের সাথে যুক্ত হতে পারে না তাকে টেলিমোর বলে। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন টেলোমিয়ার অঞ্চলে কিছু সংখ্যক DNA অণু ভাঁজ (folded) হয়ে থাকার কারণে এরা অন্য ক্রোমোজোমের সাথে সংযুক্ত হতে পারে না।
গৌণ সংকোচন বা নিউক্লিওলাস সংগঠক (Secondary
constriction or nucleolus organizer) : ক্রোমোজোমের দেহে সেন্ট্রোমিয়ার ব্যতীত অন্য কোন কুঞ্চন থাকলে তাকে সেকেন্ডারী
বা গৌণ কুঞ্চন বলে। এ ধরনের গৌণ কুঞ্চন অঞ্চলে
সাধারণত নিউক্লিয়াস সৃষ্টি হয় তাই একে নিউক্লিওলাস সংঘটক বলে।
স্যাটেলাইট (Satellite) : ক্রোমোজোমের সংকোচন দ্বারা
যুক্ত গোলাকার স্যাটেলাইট বলে। স্যাটেলাইটযুক্ত ক্রোমোজোমকে সেট ক্রোমোজোম (Set chromosome) বলে।
ক্রোমোজোমের রাসায়নিক গঠন (Chemical composition of chromosome)
ক্রোমোজোমের রাসায়নিক গঠন বেশ জটিল ধরনের হয়। ক্রোমোজোমের
মুখ্য উপাদান নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিন। নিউক্লিয়ক
এসিডের মধ্যে RNA ও DNA উভয় উপস্থিত থাকে।
DNA-এর পরিমাণ RNA-এর তুলনায় অনেক বেশি। প্রোটিনের মধ্যে হিস্টোন ও ননহিস্টোন প্রোটিন থাকে। হিস্টোন প্রোটিন
এর মধ্যে H1, H2, H3 ও H4 এই ধরনের পাওয়া যায়;
পক্ষান্তরে চার প্রায় ৫০০ ধরনের হিস্টোন প্রোটিন ক্রোমোজোমে থাকে। ক্রোমোজোম প্রোটিন কাঠামো হিসেবে কাজ করে এবং নিউক্লিক এসিডগুলি এর সাথে যুক্ত থাকে। ক্রোমোজোমে ক্রোমোসোমিন
নামক এক প্রকার প্রোটিন থাকে। এছাড়া ক্রোমোজোমে
(Chromosome DNA পলিমারেজ, নিউক্লিওসাইড ট্রাইফর্মাফাটেজ
প্রভৃতি এনজাইম এবং সামান্য পরিমাণে লিপিড Mg++, Fe++ আয়ন থাকে।
মেটাফেজ দশার ক্রোমোজোম |
ক্রোমোজোমের কাজ (Function of chromosome)
- ১। ক্রোমোজামে অবস্থিত DNA অণুই জিনের ভূমিকা পালন করে।
তাই ক্রোমোজোম যাবতীয় জৈব সংশ্লেষণমূলক কাজ নিয়ন্ত্রণ
করে।
- ২। ক্রোমোজোমের সংখ্যাগত পরিবর্তন, তার DNA অণুর যে কোন
ধরনের পরিবর্তন যেমন জিন মিউটেশন ইত্যদি
বিবর্তনের ধারাকে অব্যাহত রাখে।
- ৩। ক্রোমোজোমের জীবের বংশগতি বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে।
- ৪। প্রাণীর লিঙ্গ নির্ধারণে ক্রোমোজোম ভূমিকা রাখে।
- ৫। ক্রোমোজোম কোষ বিভাজনে সহায়তা করে।
- ৬। নিউক্লিয় উপাদান তৈরিতে ক্রোমোজোমোর ভূমিকা আছে।
ক্রোমোজোমের রাসায়নিক উপাদান (Chemical ingredient of chromosome)
ক্রোমোজোমের প্রধান রাসায়নিক উপাদান হলো: (১) নিউক্লিক অ্যাসিড ও (২) প্রোটিন।
(১) নিউক্লিক অ্যাসিড
ক্রোমোজোমে দু'ধরনের নিউক্লিক
অ্যাসিড পাওয়া যায়। যথা : (i) DNA ও (ii) RNA.
(i) DNA : DNA-এর পুরো নাম Deoxyribo Nucleic
Acid. DNA হলো প্রকৃত ক্রোমোজোমের স্থায়ী উপাদান। ক্রোমোজোমের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে DNA-এর পরিমাণ
হচ্ছে শতকরা প্রায় ৪৫ ভাগ। এটি দু’সূত্র
বিশিষ্ট পলি নিউক্লিওটাইডের সর্পিলাকার গঠন। একটির সূত্র অন্যটির পরিপূরক। এতে পাঁচ
কার্বনবিশিষ্ট পেন্টোজ শর্করা, নাইট্রোজেনঘটিত ক্ষারক
(অ্যাডিনিন, গুয়ানিন, থায়মিন ও সাইটোসিন) থাকে । এটি ৯০% ক্রোমোজোমে থাকে।
(ii) RNA : RNA এর পুরো নাম Ribo Nucleic Acid. ক্রোমোজোমে
এর পরিমাণ হচ্ছে শতকরা ০.২-১.৪ ভাগ। RNA
ক্রোমোজোমের স্থায়ী উপাদান নয়। প্রতিটি RNA অণু সাধারণত একসূত্রবিশিষ্ট। এটি পাঁচ
কার্বনবিশিষ্ট রাইবোজ শর্করা, অজৈব ফসফেট, অ্যাডিনিন,
গুয়ানিন, ইউরাসিল ও সাইটোসিন দ্বারা গঠিত। এটি ১০% ক্রোমোজোমে থাকে। ভাইরাস ক্রোমোজোমে স্থায় উপাদান হিসেবে RNA থাকে।
(২) প্রোটিন
প্রোটিন ক্রোমোজোমের মূল কাঠামো গঠনকারী
রাসায়নিক উপাদান। এ কাঠামোতে নিউক্লিক অ্যাসিড বিন্যস্ত থাকে। ক্রোমোজোমে প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ৫৫ ভাগ।
ক্রোমোজোমে দু'ধরনের প্রোটিন পাওয়া যায়। যথা: (i) নিম্ন আণবিক গুরুত্বসম্পন্ন প্রোটিন ও (ii) উচ্চ আণবিক গুরুত্বসম্পন্ন
অম্লীয় প্রোটিন।
(i) নিম্ন আণবিক গুরুত্বসম্পন্ন প্রোটিন : ক্রোমোসোমে
প্রোটামিন অথবা হিস্টোন এ দুটি ক্ষারীয় প্রোটিনের মধ্যে যে কোনো একটিকে পাওয়া যায়। তবে বেশির ভাগ ক্রোমোজোমে হিস্টোন
প্রোটিন থাকে। প্রোটামিন পাওয়া যায়
শুধু শুক্রাণুর ক্রোমোজোমে। ক্রোমোজোমে হিস্টোনের পরিমাণ DNA এর পরিমাণের কাছাকাছি
থাকে।
(ii) উচ্চ আণবিক গুরুত্বসম্পন্ন অম্লীয় প্রোটিন :
ক্রোমোজোমে বেশ কয়েক ধরনের অম্লীয় প্রোটিন থাকে। উল্লেখযোগ্য হলো DNA পলিমারেজ ও RNA পলিমারেজ।
উল্লিখিত উপাদান ছাড়াও ক্রোমোজোমে ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, লিপিড, এনজাইম, আয়রন এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ খুব অল্প পরিমাণে থাকে।
0 মন্তব্যসমূহ