অমরা কি
মনোট্রিম ব্যতীত অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ডিম্বতে কুসুম থাকে না। কুসুম (yolk) মূলত বিকাশমান ভ্রূণের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্তন্যপায়ীদের বিকাশমান ভ্রূণের জন্য সঞ্চিত খাদ্য না থাকায় গর্ভধারণকারী মাকে ভ্রূণ বিকাশের জন্য খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। মাতৃদেহ থেকে পুষ্টি সরবরাহের জন্য ভ্রূণকলা ও মাতৃকলা মিলে যে বিশেষ অঙ্গের সৃষ্টি হয় তাকে অমরা (placenta) বলে। যে পদ্ধতিতে আমরা গঠিত ও বিন্যস্ত হয় তাকে অমরাবিন্যস (placentation) বলে। মাতার দেহ ও ভ্রূণের মধ্যে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্যাদি পারাপারের জন্য ভ্রূণকলা ও মাতৃকলার সমন্বয়ে গঠিত হয় অমরা। সুতরাং বলা যায় গর্ভবতী স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মাতৃকলা ও ভ্রূণকলার সমন্বয়ে সৃষ্ট বীজ সদৃশ যে অঙ্গের সাহায্যে সরাসরি ভ্রূণ ও মাতার মধ্যে বিভিন্ন দ্রব্যাদির আদান-প্রদান ঘটে, তাকে অমরা (placenta) বলে।অমরার কাজ
অমরার কাজ বা প্রয়োজনীয়তা নিম্নে বর্ণিত হল।১. পুষ্টি (Nutrition) : প্রায় কুসুমবিহীন ভ্রূণের
পরিস্ফুটনের জন্য দরকারী পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে খাদ্যবস্ত্র, গ্লুকোজ, অ্যামাইনো এসিড ও বিভিন্ন ইলেকট্রোলাইট ব্যাপন পদ্ধতিতে অমরার
মধ্য দিয়ে ভ্রূণের রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে।
২. শ্বসন (Respiration) : অমরা ভ্রূণের শ্বসনে সহায়তা
করে। মাতার রক্ত থেকে ব্যাপন পদ্ধতিতে অক্সিজেন অমরার মাধ্যমে ভ্রূণে প্রবেশ করে। অতঃপর শ্বসনের ফলে সৃষ্ট CO2
অমরার মাধ্যমে মাতৃদেহে প্রবেশ করে।
৩. হরমোন নিঃসরণ (Secretion of hormone) : অমরা থেকে
প্রোজেস্টেরন, গোনাডোট্রফিন ইত্যাদি হরমোন নিঃসৃত করে, যা গর্ভকালীন বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে।
8. রেচন (Excretion) : বিপাকের ফলে ভ্রূণের
দেহে রেচন পদার্থ সৃষ্টি হয়। এসব রেচন পদার্থ অমরার মাধ্যমে ভ্রূণ থেকে অপসারিত হয়।
৫. প্রতিরক্ষা (Defense) : অমরা যেমন ক্ষতিকর রোগ জীবাণুকে ভ্রূণে
প্রবেশে বাধা দেয় তেমনি অমরার মাধ্যমে অনেক রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডি মাতৃদেহ থেকে ভ্রূণে ঢুকে ভ্রূণকে অনাক্রমতা দান
করে।
৬. সঞ্চয়ক (Reservoir or store house) : গ্লাইকোজেন, চর্বি,
খনিজ লবণ ইত্যাদি অমরার মধ্যে সঞ্চিত থাকে। এসব সঞ্চিত দ্রব্য ভ্রূণ কর্তৃক ব্যবহৃত হয়।
৭. বিপাক (Metabolism) : ভ্রূণের বিপাক কাজে অমরা সহায়তা করে।
বিশেষ করে প্রোটিন বিপাকে অমরা অংশগ্রহণ করে।
৮. ভ্রূণীয় সংযুক্তি (Embryonic
attachment) : অমরা ভ্রূণকে জরায়ুর প্রাচীরে আটকাতে সাহায্য করে।
৯. ভ্রূণ বহিষ্করণ প্রতিরোধ (Resist abortion) : অমরা
বর্ধনশীল ভ্রূণের বহিষ্করণ প্রতিরোধ করে।
১০. জীবাণু ও ঔষধ পরিবহন (Pathogen and drug
transportation) : অমরার মাধ্যমে ডিপথেরিয়া, গুটি বসন্ত, জলবসন্ত, সিফিলিস প্রভৃতি রোগের জীবাণু মাতৃদেহ থেকে ভ্রূণ
প্রবেশ করে। এছাড়া কিছু কিছু ঔষধ যেমন থ্যালিডোমাইড অমরার মাধ্যমে মাতৃদেহ থেকে ভ্রূণে প্রবেশ করে। এই ঔষধের প্রভাবে
ভ্রূণের পৌষ্টিকনালী ইত্যাদি বিকাশ বাধাগ্রস্ত
হয়।
অমরার প্রকারভেদ
গঠন পদ্ধতি, উৎপত্তি, আকার, আকৃতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি
ক. অতি ভ্রূণীয় পর্দা ও উৎপত্তির ধরন অনুযায়ী অমরার প্রকারভেদ
অতিভ্রূণীয় পর্দা বা ভ্রূণবহির্ভূত পর্দা
(extra embryonic membrane) ও মাতৃজরায়ুর মধ্যে
সম্পর্ক স্থাপনের ভিত্তিতে অমরার শ্রেণীবিভাগ নিম্নে
বর্ণিত হল।
১. কোরিও
ভিটেলিন অমরা (Choreovitalin placenta) : ভ্রূণের কোরিওন ও কুসুম থলির (yolk sac) সংস্পর্শে থাকা অংশটি মাতার জরায়ু প্রাচীরের সঙ্গে মিলিত হয়ে যে
অমরা সৃষ্টি করে তাকে কোরিও ভিটেলিন অমরা বলে।
কোরিও ভিটেলিন অমরা গঠনে কুসুমথলি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করে তাই একে কুসুমথলি অমরাও (yolk sac
placenta) বলা হয়ে থাকে। উদাহরণ- ক্যাঙ্গারু, অপোসোম ইত্যাদি।
২. কোরিও এলানটয়িক অমরা বা এলানটয়িক অমরা (Choreoallantoic placenta) : কোরিয়ন ও এলানটয়েস নামক ভ্রূণ বহির্ভূত পর্দাদ্বয় পরস্পর
মিলিত হয়ে কোরিও এলানটায়িক আবরণী গঠন
করে। অতঃপর এই আবরণী জরায়ু প্রাচীরের মধ্যে
প্রোথিত হয়ে যে অমরা গঠন করে তাকে কোরিওএলানটয়িক অমরা বা এলানটয়িক অমরা বলা
হয়। উদাহরণ
– কুকুর, শূকর ইত্যাদি।
৩. কোরিয়নিক অমরা (Chorionic placenta) : ভ্রূণীয় কোরিয়ন থেকে উদ্ভূত অসংখ্য ভিলাই (villi) মাতৃ জরায়ু প্রাচীরের সাথে যুক্ত হয়ে যে অমরা গঠিত হয়
তাকে কোরিয়নিক অমরা বলে। এক্ষেত্রে এলান্টয়েস অত্যন্ত ক্ষুদ্র, ফলে অমরা গঠনে এর ভূমিকা থাকে
না। উদাহরণ
– মানুষ, শিম্পাঞ্জী ইত্যাদি।
খ. ভ্রূণকলা ও মাতৃজরায়ু কলার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত্তিতে অমরার প্রকারভেদ
মাতৃজরায়ু কলা ও
ভ্রূণকলার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও প্রসবকালীন
পরিণতির ভিত্তিতে অমরার শ্রেণীবিভাগ নিম্নে বর্ণিত
হল।
১. অপতনশীল অমরা (Non deciduate placenta) : মাতৃ
জরায়ু (uterus) প্রাচীরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গর্তে ভ্রূণীয়। কোরিয়নের ভিলাই সন্নিবেশিত থেকে সৃষ্ট যে অমরা প্রসবের সময়
মাতৃকলার কোন ক্ষতি না করে ও রক্তক্ষরণ না ঘটিয়ে বাচ্চা প্রসব করে তাকে অপতনশীল অমরা বলে। উদাহরণ- গরু, ঘোড়া ইত্যাদি।
২. পতনশীল অমরা (Deciduate placenta) : মাতৃ জরায়ুর প্রাচীর ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে কোরিয়নিক ভিলাইগুলি তার মধ্যে প্রবেশের ফলে সৃষ্ট যে অমরা প্রসবের সময় মাতৃকলা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে রক্তপাত ঘটায় তাকে পতনশীল অমরা বলে। উদাহরণ- মানুষ, বানর, শিম্পাঞ্জী ইত্যাদি।
৩. পতনশীল অবহিকৃত অমরা (Deciduate attached
placenta) : যে অমরার ভ্রূণকলা ও মাতৃকলা পরস্পর মিলিত হয়ে নিবিড় ও দৃঢ়ভাবে ব্রীজ (bridge) গঠন করে এবং
প্রসবকালে ভ্রূণীয় কলার অংশ মাতৃ অংশের সাথে রয়ে যায় তাকে পতনশীল অবহিষ্কৃত অমরা বলে। এক্ষেত্রে ভ্রূণকলা
পরে মাতৃদেহে পরিশোষিত (absorbed) হয়। উদাহরণ- ছুঁচো (Mole), পিরামিলিশ (Perameless) ইত্যাদি।
0 মন্তব্যসমূহ