প্লাজমালেমা বা কোষ আবরণী বা প্লাজমাপর্দা কি (Plasma lemma)
প্রাণীকোষের প্রোটোপ্লাজম অংশটি সজীব, সক্রিয়, স্থিতিস্থাপক, অতি পাতলা, অর্ধভেদ্য, নমনীয় ও লাইপ্রোপ্রোটিন নির্মিত যে পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে, তাকে প্লাজমা পর্দা বা কোষ আবরণী বা প্লাজমালেমা বলে। C.Nageli ও Cramer ১৮৫৫ সালে সর্বপ্রথম কোষ আবরণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করেন অতঃপর Nageli একই বছরের এটার Cell membrane নামকরণ করেন সাইটোপ্লাজমের বহিঃস্তর পরিবর্তিত হয়ে প্লাজমা পর্দা গঠিত হয়।গঠন (Structure)
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে গটার ও গ্রেণ্ডেল কোষ আবরণীকে দ্বিস্তরী লিপিড ও প্রোটিন হিসেবে উল্লেখ করেন। অতঃপর ড্যানিয়েলি ১৯৩৫ ও স্মিট ১৯৪০ প্লাজমাপর্দাকে প্রোটিন ও লিপিডের ত্রিস্তর পর্দা হিসেবে বর্ণনা দেন। পরবর্তীতে ড্যানিয়েলি ও ড্যাভসন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মত প্রকাশ করেন যে কোষ আবরণী দ্বিস্তরী এবং প্রতিটি আবরণের বাইরের দিকে প্রোটিন ও ভেতরের দিকে লিপিড থাকে। প্লাজমা পর্দা গঠন সম্পর্কে সর্বাধুনিক মতামত প্রকাশ করে ১৯৭২ সালে সিঙ্গার ও নিকলসন। এদের প্রবর্তিত মডেলটিকে সিংগার ও নিকলসনের ফ্লুইড মোজাইক মডেল বলে। প্লাজমা পর্দার ফ্লুইড মোজাইক মডেল নিম্নে বর্ণিত হল।
ফ্লুইড মোজাইক মডেল (Fluid mosaic model)
সিঙ্গার ও নিকলসনের মতামত অনুযায়ী প্লাজমা পর্দা
একটি সুস্থির ও নিরেট পর্দা নয়। প্লাজমা পর্দা প্রকৃতপক্ষে
তরল সে কারণে নিয়ত পরিবর্তনশীল ও সক্রিয় থাকে। গঠন অনুসারে প্লাজমা
পর্দার দ্বিস্তরী তরল ফসফোলিপিড ধাত্রের মধ্যে পেরিফেরিয়াল
(বহিঃস্থ) ও ইন্টিগ্রাল (অন্তঃস্থ) প্রোটিন অণু থাকে। এছাড়া কার্বোহাইড্রেট, কোলেস্টেরল ইত্যাদির অণু এখানে বিভিন্ন মাত্রায়
অনেকটা মোজাইকের মত বিন্যস্ত থাকায় একে ফ্লুইড মোজাইক মডেল বলা হয়।
প্লাজমালেমর ফ্লুইড মোজাইক মডেলের চিত্র |
প্রকৃতপক্ষে ফসফোলিপিড ধাত্র দুটি স্তরে বিন্যস্ত
থাকে। প্রত্যেক স্তরের ফসফোলিপিড অণুগুলি বাইরের প্রান্তে পানিগ্রাহী মস্তক ও অপর প্রান্তে পানিবিদ্বেষী লেজ থাকে। প্লাজমা পর্দার
ফসফোলিপিড় অণুর ফাঁকে ফাঁকে কোলেস্টরল অণু থাকে । ফলফোলিপিড ও কোলেস্টরল অণুর মাঝে ভাসমান অবস্থায় স্ফীতকায়
অনেক প্রোটিন অণু বিদ্যমান। এগুলি বিন্যাসের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত তিনভাগে ভাগ করা যায়।
১. বহিঃস্থ প্রোটিন (Peripheral protein) : এগুলি
ফসফো-লিপিড স্তরের বহিঃ অথবা অন্তঃতল সংলগ্ন থাকে।
২. অন্তঃস্থ প্রোটিন (Integral protein) : এগুলি ফসফোলিপিড
স্তরে আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে প্রবিষ্ট থাকে।
৩. আন্তঃপর্দা প্রোটিন (Transmembrane protein) :
এসব প্রোটিন ফসফোলিপিডের উভয় স্তর জুড়ে অবস্থান করে। কিছু কিছু ফসফোলিপিড অণু ও অধিকাংশ প্রোটিন অণুর সাথে
শ্বেতসার শৃঙ্খল সংযুক্ত থাকে। তাই এদেরকে যথাক্রমে গ্লাইকোলিপিড ও গ্লাইকো প্রোটিন বলে। শ্বেতসার শৃঙ্খলগুলি সব সময়
প্লাজমা পর্দার বহিঃতলে থাকে।
প্লাজমা পর্দার রাসায়নিক গঠন (Chemical structure of plasma membrane)
প্লাজমা পর্দা মূলত লিপিড, প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট-এর সমন্বয়ে গঠিত।
প্রোটিন (Protein)
প্লাজমা পর্দায় ৬০-৮০ ভাগ প্রোটিন থাকে। প্রোটিনের
মধ্যে বহিঃস্থ, অন্তঃস্থ ও আন্তঃপর্দা প্রোটিন থাকে। বহিঃস্থ প্রোটিনের মধ্যে স্প্রেকটিন, টেকটিন, সাইটোক্রম
C উল্লেখযোগ্য। প্লাজমা পর্দায় প্রায় ৩০ প্রকারের এনজাইম থাকে। এদের মধ্যে অ্যালডোলেজ, মনো অ্যামাইনো অক্সিডেজ,
RNA, অ্যাডেনাইল সাইক্লেজ, নিউক্লিওটাইডেজ,
অ্যালকালাইন ফসফাটেজ উল্লেখযোগ্য।
লিপিড (Lipid)
প্লাজমা পর্দার ২০-৪০ ভাগ লিপিড। প্লাজমার অধিকাংশই
গাঠনিক ফসফোলিপিড। এছাড়া প্লাজমা পর্দায় কয়েক ধরনের ফ্যাটি এসিড যেমন- মিরিস্টিক এসিড, পামিটিক
(Palmitic) এসিড, স্টিয়ারিক এসিড ইত্যাদি বিদ্যমান।
কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate)
প্লাজমা পর্দার কার্বোহাইড্রেট উপাদান প্রোটিনের সাথে
ও লিপিডের সাথে যুক্ত হয়ে যথাক্রমে
গ্লাইকো প্রোটিন ও গ্লাইকো লিপিড গঠন করে। এখানে বিভিন্ন মনোস্যাকারাইড যেমন D
glucose, D galactose, D glucosamine,
Sialic acid ইত্যাদি পরস্পর যুক্ত হয়ে অলিগোস্যাকারাইড গঠন করে। গ্লাইকো লিপিডের
মধ্যে গ্লাইকোফিংগোলিপিড, স্টেরল গ্লাইকোসাইড ইত্যাদি
উল্লেখযোগ্য।
প্লাজমা পর্দার কাজ (Function of plasma membrane)
- ১. এটা কোষের সব বস্তুকে ঘিরে রাখে।
- ২. প্লাজমা পর্দা একটি কাঠামো হিসেবে কাজ করে।
- ৩. এটা কোষীয় বস্তুকে ধারণ করে।
- ৪. কোষ পর্দার মধ্যে দিয়ে বস্তুর আদান-প্রদান হয়।
- ৫. কোষ পর্দা বিভিন্ন রকম তথ্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
- ৬. এটা কোষকে যেমন আকৃতি দান করে তেমনি অন্য কোষ থেকে পৃথক রাখে।
- ৭. বাইরের প্রতিকূল অবস্থা থেকে কোষ পর্দা কোষস্থ বস্তুকে রক্ষা করে ।
- ৮. প্লাজমা পর্দায় অবস্থিত প্রোটিন অণু মেমব্রেনকে উদ্দীপনা গ্রাহক অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
- ৯. কোষ পর্দা শ্বসনসহ নানা ধরনের শারীরবৃত্তীয় কাজে শক্তি পরিবহনে সাহায্য করে।
- ১০. প্লাজমা পর্দা ফ্যাগোসাইটোসিস পদ্ধতিতে কঠিন কণা ও পিনোসাইটোসিস পদ্ধতিতে তরল পদার্থ গ্রহণ করে।
0 মন্তব্যসমূহ